যে দেশের নারীদের বিয়ে নয়, বরং ধুমধাম পার্টির আয়োজন হয় বিচ্ছেদের!

বিয়ে মানেই সুখ-শান্তি আর অনাবিল স্বপ্ন বুননের এক রাজ্য। যেখানে দুজন মানুষ হাজারো স্বপ্ন দেখে সুখে থাকার, একে অন্যের সঙ্গে দুঃখ ভাগ করে নেয়ার। তারপরও অনেক সম্পর্কেই কোনো না কোনো কারণে বিচ্ছেদ ঘটে যায়।

আর বিচ্ছেদ মানেই একজন নারীর জীবনে নেমে আসে অন্ধকার। এক কথায় বিচ্ছেদ মানেই সেই নারীর ‘জীবন শেষ’। এমন ধারণাই সবার মধ্যে চলে আসছে যুগের পর যুগ ধরে। তবে পৃথিবীর একটি দেশে এই ধারণাটির কোনো মূল্যই নেই। যেখানে বিয়ে নয়, বরং বিচ্ছেদের পর নারীদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে তার পরিবার। দেশটি মৌরিতানিয়া নামে পরিচিত।

তুরস্কের জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম টিআরটি ওয়ার্ল্ডে মৌরিতানিয়ার এই বিচ্ছেদ প্রথার কথা বিস্তারিত জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দিনে দিনে নারীদের এই আয়োজন আরো বিস্তৃত হচ্ছে।

স্বামীর ঘরের ‘যন্ত্রণা’ পেরিয়ে নিজের ঘরে মেয়েরা আরেকবার ফিরে আসার সুযোগ পায়। এই খুশিতে দেশটিতে এভাবে বিচ্ছেদ উদ্যাপন করা হয়। পরিবারের অন্য সদস্যরাও বিষয়টি স্বাভাবিক চোখে দেখেন। তারা মনে করেন, ভালোর জন্যই মেয়ে ফিরে এসেছে।

এই ফিরে আসাকে তারা ‘কলঙ্কমুক্ত’ জীবনের সুযোগ হিসেবেও দেখেন। তাই একটি ব্যর্থ সম্পর্কের ইতি ঘটায় তারা আনন্দে ভেসে যায়। পাড়া কিংবা গ্রামের অন্যরা সেই আনন্দে শামিল হন। সব আয়োজন শেষ হলে বিচ্ছেদী নারী অবিবাহিতদের কাতারে চলে যান।

বিচ্ছেদের পর পার্টি মৌরিতানিয়াদের

যেভাবে আয়োজন করা হয়
ডিভোর্সের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলে সন্তানদের নিয়ে মায়ের বাড়িতে ফেরেন নারীরা। ফেরার দিন মা এবং বোনেরা মেয়েকে স্বাগত জানানোর জন্য জাগুরতা বা আনন্দের কান্নাকাটির শব্দ করে। চারদিক ভেসে যায় সেই সুরের মূর্ছনায়। পরিবারে আয়োজন শেষ হলে তার বান্ধবীরা গানের আসর বসায়। সেখানে নতুন কবিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়, যারা নতুন জীবনে ফেরা নারীর সৌন্দর্যের প্রশংসা করে আবৃত্তি করেন।

মৌরিতানিয়ার কোনো কোনো অঞ্চলে নারীর বিচ্ছেদ উদ্যাপন করতে অবিবাহিত কোনো ছেলেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এর উদ্দেশ্য ডিভোর্স দেয়া স্বামীর হিংসা জাগানো। তিনি কীভাবে এমন ‘সুন্দর’ একজন মেয়েকে ডিভোর্স দিতে পারলেন, সে কথা এই পার্টির মাধ্যমে তাকে জানানো হয়।

পুরুষের চোখে নারী
মৌরিতানিয়ার পুরুষেরা ডিভোর্সি নারীকে অবিবাহিত নারীদের মতোই মনে করে। এসব নারীকে অনেকে কবিতায় তুলে ধরেন। মৌরিতানিয়ার মানুষের জীবনে কবিতার ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। সন্ধ্যার পর ছোট থেকে বৃদ্ধ সবাই কবিতার আসর বসান। সেখানে তিনবার বিশেষ চা সরবরাহ করা হয়। প্রথমবারের চা একটু তেতো স্বাদের। পরের দুইবার মিষ্টি। এই আসরে তরুণ লেখকেরা সবাইকে কবিতা পড়ে শোনান।

অল্প বয়স থেকেই দেশটির শিশুদের কবিতা লেখার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। মরফোলজি, সিনট্যাক্স, ইনফ্লেকশন-সহ সাহিত্যের খুঁটিনাটি সব শেখানো হয়। শেখানো হয় বক্তৃতার কৌশল।

মৌরিতানিয়া নারী

যেভাবে শুরু হলো এ নিয়ম
মৌরিতানিয়ার ঐতিহ্য নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করা একজন ব্যক্তি টিআরটিকে বলেন, উপজাতিদের পুরোনো প্রথা থেকে এসব এসেছে। আগেকার দিনে অল্প কয়েকটি উপজাতিদের বসবাস ছিল দেশটিতে। অসম বর্ণে বিয়ে হতো না। কাজিনের মতো আত্মীয়র সঙ্গে নারীদের বিয়ে দেয়া হতো। বিচ্ছেদ হয়ে গেলে তাদের নানাভাবে হেনস্তা করা হতো।

কিন্তু এখন আর সেই অবস্থা নেই। তারা বুঝতে শিখেছে, নারীদের জীবন কঠিন হয়ে গেলে অন্যদের ওপর তার প্রভাব পড়ে। দেশটিতে নারীরা একাধিক বিয়ে করলে কোনো সমালোচনা হয় না।

সেখানে বসবাসরত একজন নারী টিআরটিকে বলেন, ‘আমার কিছুদিন আগে বিচ্ছেদ হয়েছে। আর করার ইচ্ছা নেই।’ তিনি ‘খুব ভালো আছেন’ বলে জানান।

বিচ্ছেদের এই উদ্যাপনে নারীরা ভালো থাকলেও পুরুষদের হয় বিপত্তি। ডিভোর্সের হার গত কয়েক দশকে দেশটিতে বেড়েছে। ডিভোর্সি পুরুষকে নারীরা আবার বিয়ে করতে চায় না। অন্যদিকে ডিভোর্সি নারীকে ‘অভিজ্ঞ’ মনে করে অবিবাহিত পুরুষেরা। তাদের ধারণা, যার ডিভোর্স হয়েছে সে সংসার সম্পর্কে ভালো বোঝে। সব সামাল দেয়ার ক্ষমতা তার বেশি।

মৌরিতানিয়ার ২০১৮ সালের এক সরকারি রিপোর্টে বলা হয়, এক তৃতীয়াংশ বিয়ে ডিভোর্সের পরিণতি পেয়েছে। জরিপে বলা হয়, ৭৪ শতাংশ নারী আবার বিয়ে করেছেন। ২৫ শতাংশ বিয়ে করেনি। ৭ শতাংশ নারী তিন কিংবা তার বেশিবার বিয়ে করেছেন।