• মঙ্গলবার ৩০ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৭ ১৪৩১

  • || ২০ শাওয়াল ১৪৪৫

লকডাউনেও তুঙ্গে চোরাকারবার

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ৩ মে ২০২১  

চলছে ধরপাকড়। একের পর এক জব্দ হচ্ছে স্বর্ণের বার। তবুও সোনার অবৈধ কারবার থামছেই না। লকডাউনের কড়াকড়ির মধ্যেও চলছে এ চোরাকারবার। গত শুক্রবারও বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে সিটের নিচ থেকে পাওয়া গেছে ২৮টি স্বর্ণের বার। অথচ দেশে স্বর্ণের ব্যাপক চাহিদা মোতাবেক আমদানি হচ্ছে না। এর কারণও চোরাকারবার। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিমানবন্দর দিয়েই আসা-যাওয়া করছে চোরাকারবারিরা। ধরাও পড়ছে এসব বিমানবন্দরে বেশি। তবে এসব স্বর্ণ দেশে এসে যে থেকে যাচ্ছে, তা নয়। হচ্ছে পাচার। পাচারের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ- এমনটাই মনে করছেন অপরাধ বিষয়ক বিশ্লেষকরা। অন্যদিকে প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তারও আগেই দিয়েছেন এমন তথ্য। কাস্টমস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলেছেন, যত সোনা ধরা পড়ছে, তার কয়েক গুণ বেশি সোনা পাচার হয়ে যাচ্ছে। তবে পাচার আগের চেয়ে কমলেও তা পুরোপুরি বন্ধ করা যাচ্ছে না।

কয়েক মাস আগে সোনা চোরাচালানের মামলা তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, চোরাচালানে জড়িত ২৬টি চক্রকে পুলিশ শনাক্ত করেছে। এ দলে রয়েছেন বড় বড় রাঘোব বোয়াল। তারা দুবাই, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া থেকে আনেন চালান। আবার ভারতের স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যোগসাজশে চলে পাচার প্রক্রিয়া। যদিও ওই সব রাঘববোয়ালরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যান। প্রবাসী যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিদিনই স্বর্ণ আসে। এসব স্বর্ণ যাত্রীর নিজস্ব মালামাল হিসেবে আনা হলেও দেশে পৌঁছানোর পর চলে যায় স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের হাতে। হয় পাচারও। লকডাউনেও থেমে নেই এমন সব কাণ্ড। যদিও বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি- বাজুস এসব তথ্য মেনে নিতে অনেকটাই নারাজ। তাদের তথ্য মতে, ‘ব্যবসায়ীরা পুরনো স্বর্ণ রিফাইনিং করে চাহিদা মোচ্ছেন!’ তবে বাজুসের একাধিক সদস্যের কাছ থেকে জানা যায়, দেশে হাতেগোনা কয়েকটি জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান বৈধভাবে দুবাই থেকে স্বর্ণ আমদানি করে। সিংহভাগই ‘লাগেজপার্টি’র কাছ থেকে স্বর্ণ বার কিনে থাকেন।

এদিকে রাজধানীর স্বর্ণ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এদেশের তুলনায় প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে স্বর্ণের বাজার কয়েক গুণ বড়। আবার সেখানে সোনার আমদানি শুল্ক অনেক বেশি। শুল্ক ফাঁকি দিতে তাই বাংলাদেশ থেকে সেদেশে পাচারের প্রবণতা আছে।

জানা গেছে, স্বাভাবিক সময় যে সব প্রবাসী ভিজিট বা টুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশ থেকে চাকরির জন্য দুবাই যান। অথচ ভিসা না থাকায় তারা চাকরি পান না। চাকরি পেলেও টুরিস্ট ভিসা থাকায় অনেক কম টাকা বেতন পান। স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা তাদের টার্গেট করেন। তাদের অর্থের লোভ দেখিয়ে নিজেদের এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেন।

এদিকে ঈদ সন্নিকটে। বেড়েছে স্বর্ণের চাহিদা। ঈদকে সামনে রেখে তাই লকডাউনের থেমে নেই স্বর্ণের চোরা কারবার। গত শুক্রবার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দুবাই থেকে আসা বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে সিটের (আসনের) নিচ থেকে ২৮টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করেছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। শুল্ক গোয়েন্দা জানায়, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে চোরাচালান প্রতিরোধে কাস্টমস গোয়েন্দার কর্তব্যরত কর্মকর্তারা বিমানবন্দরের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে নজরদারি করছিলেন। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার রাত দুইটায় বাংলাদেশ বিমানের দুবাই থেকে আসা একটি ফ্লাইট (বিজি-৫০৪৬) তল্লাশি করা হলে বিমানের সিটের নিচে অভিনব উপায়ে লুকানো ২৮টি বার পাওয়া যায়।

বারগুলোর মোট ওজন ৩ কেজি ২৪৮ গ্রাম, যার বাজারমূল্য প্রায় দুই কোটি ছয় লাখ ২৫ হাজার টাকা। সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শফিকুল ইসলামের তথ্যমতে, উদ্ধার করা স্বর্ণের বিষয়ে কাস্টমস আইনে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ফৌজদারি মামলাও করা হয়েছে। তবে এ ঘটনায় কেউ আটক হয়নি।

লকডাউনের মধ্যেই গত ১৯ এপ্রিল ভারতে পাচারকালে সাতক্ষীরার সদরের শিকড়ি সীমান্তে দুটি স্বর্ণের বার জব্দ করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। এ সময় শিকড়ি গ্রামের নূর ইসলাম নামের একজনকে আটক করা হয়েছে। সেদিন সাতক্ষীরা বিজিবির ৩৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আল মাহমুদ জানান, বিজিবির কালিয়ানী ক্যাম্প সদস্যরা টহলের সময় এক ব্যক্তির মুখোমুখি হন। এ সময় তার মোটরসাইকেল থামিয়ে দেহ তল্লাশি করে দুটি স্বর্ণের বার জব্দ করা হয়। জব্দকৃত স্বর্ণের মূল্য প্রায় ২৫ লাখ টাকা বলে জানিয়েছেন বিজিবি অধিনায়ক। এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা সদর থানায় একটি মামলা হয়েছে।

একই দিন ধামরাইয়ে নকল স্বর্ণের বারসহ নারী আটক হন। ধামরাই উপজেলার দক্ষিণ পাড়ায় স্থানীয়রা তাকে ধরে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে। আটক রিনা বেগম (৫০) আশুলিয়ার গাজিরচট এলাকার আইয়ুব আলীর স্ত্রী। ধামরাই থানার উপ-পরিদর্শক আবদুস সালাম জানান, মোবাইল ফোনে ধামরাই এলাকার এক ব্যক্তির কাছে একটি স্বর্ণের বার বিক্রির কথা বলে ওই নারী। পরে তাকে ধামরাই আসতে বলা হয়। স্বর্ণের বারটি নিয়ে ধামরাই দক্ষিণ পাড়া আসার পর স্বর্ণকারের দোকানে পরীক্ষা করলে তা নকল প্রমাণিত হয়। পরে স্থানীয়রা ওই নারীকে আটকে রেখে ধামরাই থানায় খবর দিয়ে পুলিশের কাছে সোপর্দ করে।

জানা যায়, এ ঘটনায় বার কিনতে চাওয়া ওই ব্যক্তিকে আইনের আওতায় আনা হয়নি।

এদিকে লকডাউন শুরুর ঠিক তিন দিন আগে কোটি টাকার স্বর্ণের বারসহ পাচারকারী আটক হন। দেশের মানুষের মুখে মুখে যখন লকডাউনের কথা চাউর হয়ে আছে, ঠিক তখন (১ এপ্রিল) যশোরের বেনাপোলের পুটখালী সীমান্ত এলাকায় ঘটে এ ঘটনা। প্রায় ২ কেজি ওজনের ১৫টি সোনার বারসহ রানা হামিদ (২৬) নামে এক পাচারকারীকে আটক করেছেন বিজিবি সদস্যরা। পরে তাকে শার্শা থানায় হস্তান্তর করা হয়। আটক রানা হামিদ দীর্ঘদিন ধরে চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত বলে স্বীকার করে। ২১ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মঞ্জুর এলাহী স্বর্ণ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আটক না হওয়া মানেই অপরাধীরা সতর্ক হয়ে যাওয়া। তারা নতুন নতুন উপায় বের করবে। এদিকে আমাদের কাসটমস্ও এগিয়ে যাচ্ছে। তবে ‘চোরপুলিশ’ খেলা খেলে চোরাকারবার রুখে দেওয়া যাবে না। প্রয়োজন- গড ফাদারদের আইনের আওতায় আনা।