• শনিবার ১৮ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

  • || ০৯ জ্বিলকদ ১৪৪৫

সেনানায়ক থেকে রাষ্ট্রনায়ক এরশাদ

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১৪ জুলাই ২০১৯  

এরশাদের কর্মজীবন শুরু হয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। ছাত্রজীবনেও তিনি রাজনীতির সংস্পর্শে আসেননি। মৃত্যুর আগে তার বড় পরিচয় ছিল তিনি একজন রাজনীতিবিদ। রাষ্ট্রপ্রধান হয়েছেন, সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, সর্বশেষ ছিলেন একাদশ সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা।

বাংলাদেশের রাজনীতির আন প্রেডিকটেবল নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত টানা ৩৭ বছরের প্রতিটি নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন তিনি। এরশাদের চাকরি, রাজনীতি ও পারিবারিক জীবন এমন কি মৃত্যুর আগের প্রতিটি মুহুর্ত ছিলো নানা রহস্যে ঘেরা।

এইচ এম এরশাদের জন্ম (১ ফেব্রুয়ারি ১৯৩০ মতান্তরে ২০ মার্চ ১৯৩০) বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রাম শহরের লাল দালান বাড়ি খ্যাত নানা বাড়িতে জন্ম হয় তার। বাংলাদেশের সাবেক সেনা প্রধান, একসময়ের প্রধান সামরিক প্রশাসক ও রাষ্ট্রপতি। রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা। মৃত্যুর সময় ছিলেন জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের সরকারকে উৎখাত করে এরশাদ রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে দেশে সামরিক শাসন জারি এবং নিজেকে প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে ঘোষণা দেন। এরপর ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এএফএম আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৮৬ সালে সংসদীয় নির্বাচনে তিনি স্বপ্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টির ভোটপ্রার্থী হিসেবে অংশ নেন এবং পরে ৫ (পাঁচ) বৎসরের জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণঅভ্যুত্থানের মুখে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।

শৈশব ও শিক্ষা: আইনজীবী বাবার চাকরির সুবাদে পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার জেলা ও নিজ শহর রংপুরে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি। এরপর ১৯৫০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।

সেনাবাহিনীতে এরশাদ: ১৯৫২ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। ১৯৬০-১৯৬২ সাল তিনি চট্টগ্রাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কেন্দ্রে অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৬ সালে তিনি কোয়েটার স্টাফ কলেজ থেকে স্টাফ কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৯৬৮ সালে তিনি শিয়ালকোটে ৫৪ ব্রিগেডের মেজর ছিলেন। এরপর ১৯৬৯ সালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি লাভের পর ১৯৬৯-১৯৭০ সাল ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ও ১৯৭১-১৯৭২ সালে ৭ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক হিসেবে কর্মরত ছিলেন।

পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরার পর ১৯৭৩ সালে তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অ্যাডজুটেন্ট জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। ১২ ডিসেম্বর ১৯৭৩ সালে তিনি কর্নেল ও ১৯৭৫ সালের জুন মাসে সেনাবাহিনীতে ব্রিগেডিয়ার পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭৫ সালের ২৪ অগাস্ট ভারতে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় তিনি মেজর জেনারেল হিসেবে পদোন্নতি পান ও উপসেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োগ পান।

রাষ্ট্রপতি এরশাদ: ১৯৮১ সালের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর আব্দুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি হন।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি আবদুস সাত্তারের সরকারকে উৎখাত করে রাষ্ট্র ক্ষমতা গ্রহণ করেন এরশাদ। একই সঙ্গে দেশে সামরিক শাসন জারি এবং নিজেকে প্রধান সামরিক শাসক হিসেবে ঘোষণা দেন। এরপর ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি বিচারপতি এএফএম আহসানউদ্দিন চৌধুরীকে অপসারণ করে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

এরশাদ দেশে উপজেলা পদ্ধতি চালু করেন এবং ১৯৮৫ সালে প্রথম উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮৬ সালে তিনি জাতীয় পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এই দলের মনোনয়ন নিয়ে ১৯৮৬ সালে পাঁচ বছরের জন্য দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও জামায়াত এই নির্বাচনে অংশ নেয় তবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল এই নির্বাচন বয়কট করে। সাধারণ নির্বাচনে তার দল সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করে।

বিরোধী দলের আন্দোলনের মুখে রাষ্ট্রপতি ৭ ডিসেম্বর ১৯৮৭ সালে এই সংসদ বাতিল করেন। ১৯৮৮ সালের সাধারণ নির্বাচন সব দল বয়কট করে এবং ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর গণঅভ্যুত্থানের মুখে তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন, ১৯৮৬: রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৫ অক্টোবর ১৯৮৬ সালে। এই নির্বাচনে জয়লাভ করেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। এ নির্বাচনে ১৬ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। বাছাইয়ে কোন প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বাদ না পড়ায় বৈধ প্রার্থীর সংখ্যা দাঁড়ায় ১৬ জন। ৪ জন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করায় সর্বশেষ প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ছিলেন ১২ জন। ওই নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বীরা হলেন, অলিউল ইসলাম চৌধুরী (সুক্কু মিয়া), আলহাজ মাওলানা খায়রুল ইসলাম যশোরী, আলহাজ মেজর (অব) আফসার উদ্দিন, মুহাম্মদ আনছার আলী, মওলানা মোহাম্মদুল্লাহ (হাফেজি হুজুর), মোহাম্মদ খলিলুর রহমান মজুমদার, মো. আব্দুস সামাদ, মো. জহির খান, অবসরপ্রাপ্ত লেফটেনেন্ট কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সৈয়দ মুনিরুল হুদা চৌধুরী, অবসরপ্রাপ্ত স্কো. লি. মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

গ্রেফতার: ১৯৯০ সালে ক্ষমতা হারানোর পর গ্রেফতার হন এরশাদ। ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে তিনি কারাগার থেকে অংশ নিয়েও রংপুরের পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। বিএনপি সরকার তার বিরুদ্ধে প্রায় অর্ধশত মামলা করে। তার মধ্যে কয়েকটিতে তিনি দোষী সাব্যস্ত হন এবং সাজাপ্রাপ্ত হন। ১৯৯৬ সালের সাধারণ নির্বাচনেও তিনি পাঁচটি আসন থেকে নির্বাচিত হন। তবে আদালতের রায়ে দন্ডিত হওয়ার কারণে সংসদে তার আসন বাতিল হয়ে যায়। ছয় বছর অবরুদ্ধ থাকার পর ৯ জানুয়ারি ১৯৯৭ সালে তিনি জামিনে মুক্তি পান।

এরপর তার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় পার্টি ২০০০ সালে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে, যার মধ্যে মূল ধারার চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনে তার পার্টি সংসদে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে এবং তার স্ত্রী রওশন এরশাদ প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা হন। সর্বশেষ ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনেও জাতীয় সংসদে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি। আর প্রধান বিরোধী দলীয় নেতা হন এরশাদ।