• রোববার ০৫ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২২ ১৪৩১

  • || ২৫ শাওয়াল ১৪৪৫

চাপ কমবে রিজার্ভে

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩  

ডলারের ওপর নির্ভরতা কমাতে গত জুলাই থেকে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে রুপিতে বাণিজ্য পরিচালনার উদ্যোগ নেয় প্রতিবেশী দুই দেশ। বাংলাদেশ ব্যাংক শুরুতে সোনালী ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডকে এই কার্যক্রমে যুক্ত করে। চলতি মাসেই ইসলামী ব্যাংক এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংককে ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য পরিচালনার অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ ছাড়া আরও ছয় ব্যাংক রুপিতে বাণিজ্য পরিচালনার অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন জমা দিয়েছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, রুপিতে লেনদেনের ব্যবস্থা হওয়ায় আপাতত তাদের ডলার নির্ভরতায় খুব কম পরিমাণে হলেও চাপ কিছুটা কমেছে। তবে এর পুরো সুবিধা নিতে ভারতে রপ্তানি আরও বাড়াতে হবে বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে ব্যবসায়ীদের আগ্রহ থাকলেও ইউয়ানের মজুত না থাকায় ঋণপত্র খুলতে পারছে না দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। চীনা মুদ্রার মজুত বাড়াতে দেশটিতে পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর পাশাপাশি ঋণ ও বিনিয়োগের একটা অংশ ইউয়ানে নেওয়া যেতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা। ভারত ও চীনা মুদ্রার এই পথচলার মধ্যেই সম্প্রতি বাংলাদেশকে রুশ মুদ্রা ‘রুবল’ ব্যবহার করে বাণিজ্যের অনুমতি দিয়েছে দেশটির সরকার। এই বিনিময়ের ফলে চাপ কমবে রিজার্ভের ওপর। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, বাংলাদেশের অফিসিয়াল মুদ্রা তালিকায় রাশিয়ার রুবল নেই। ফলে চাইলেও বাংলাদেশের কোনো ব্যাংক বা ব্রোকার আপাতত রাশিয়ার মুদ্রাবাজারে রুবল কেনাবেচা করতে পারবে না। বিকল্প বাণিজ্য সুবিধার পাশাপাশি ভবিষ্যতে রুবলে বাণিজ্যিক লেনদেন আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে বৈচিত্র্য আনবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ভারত থেকে বছরে প্রায় ১৪ বিলিয়ন বা ১৪০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। বিপরীতে দুই বিলিয়ন বা দুইশ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। এই বাস্তবতায় গত ১১ জুলাই ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য চালু হওয়ার সময় সোনালী ব্যাংক এবং ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডকে (ইবিএল) বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পণ্য আমদানি-রপ্তানির জন্য ডলারের পরিবর্তে রুপিতে এলসি খোলার অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর এই তালিকায় যুক্ত হয় ইসলামী ব্যাংক এবং স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক। এ ছাড়া আরও ছয় ব্যাংক- ট্রাস্ট ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক, এবি ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক এবং প্রিমিয়ার ব্যাংক রুপিতে বাণিজ্য পরিচালনার অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আবেদন জমা দিয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে।

ভারতের সঙ্গে রপ্তানির ক্ষেত্রে রুপিতে বাণিজ্য করছে বাংলাদেশের প্রাণ গ্রুপ এবং ওয়ালটন গ্রুপ। এই দুটি প্রতিষ্ঠানেরই পণ্যের ভালো চাহিদা রয়েছে ভারতের বাজারে। এর মধ্যে প্রাণ মূলত তাদের ফুড আইটেম ভারতে রপ্তানি করে, প্রতিষ্ঠানটির পণ্য ভারতের ২৮টি রাজ্যে গেলেও, প্রাণের উৎপাদিত পণ্যের বড় বাজার দেশটির সেভেন-সিস্টার নামে পরিচিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যসমূহ। আর ভারত থেকে প্রাণ প্লাস্টিক প্যাকেজিংয়ের কাঁচামাল আমদানি করে। প্রাণ গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইলিয়াস মৃধা জানান, ‘আমরা ভারতে নিয়মিত পণ্য রপ্তানি করি, এবার আমরা রুপিতে পেমেন্ট পেলাম।

সেটা দিয়ে আবার এলসি খুলে আমদানিও করলাম।’ অন্যদিকে, সম্প্রতি স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের মাধ্যমে রুপিতে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য করেছে ওয়ালটন। এই প্রতিষ্ঠানটি মূলত পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় রেফ্রিজারেটর এবং নানা ধরনের বৈদ্যুতিক পাখা বা ফ্যান রপ্তানি করে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে তিন লাখ রেফ্রিজারেটর ভারতে রপ্তানি করেছে ওয়ালটন। এ ছাড়া ভারত থেকে বিভিন্ন পণ্যের কাঁচামাল আমদানি করে তারা। 

রুপিতে বাণিজ্য ব্যবস্থার বিষয়ে ব্যাংকাররা বলেন, প্রথমে ব্যবসায়ীরা পণ্য রপ্তানি করবেন এবং দাম পাবেন রুপিতে। এটি ভারতের সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নস্ট্রো অ্যাকাউন্টে জমা করা হবে। পরে ব্যবসায়ীরা তাদের অর্জিত রুপি থেকে আমদানি খরচ পরিশোধ করতে পারবেন। এতে করে ডলারকে রুপি বা টাকায় রূপান্তরের সময় যে লোকসান হতো, তা আর হবে না। এই বাণিজ্য প্রক্রিয়া ভবিষ্যতে আরও সম্প্রসারিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে উল্লেখ করে একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা বলেন, ‘বর্তমানে বিশ্বে ১৮টি দেশ রুপিতে বাণিজ্য করে। যেহেতু আমাদের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বাড়ছে, আমরা অন্যান্য দেশে রপ্তানির মাধ্যমে রুপিতে পেমেন্ট পেতে পারি, যা ভারত থেকে আমদানির খরচ মেটাতে সাহায্য করবে।’

ইবিএল-এর অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক আহমেদ শাহীন বলেন, রুপিতে লেনদেন আমাদের ব্যাংকের জন্য কিছুটা নতুন অভিজ্ঞতা। এটি মাত্র শুরু হয়েছে। তাই প্রাথমিকভাবে আমদানি-রপ্তানি অল্প পরিমাণে হলেও ধীরে ধীরে এর পরিমাণ বাড়বে। রুপি দিয়ে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলার আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমানে, আমরা বছরে প্রায় দুই বিলিয়ন ডলারের পণ্য ভারতে রপ্তানি করে থাকি। অর্থাৎ, আমাদের আমদানির ১৪ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে আমরা দুই বিলিয়ন ডলারের পেমেন্ট রুপিতে করতে পারব। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য যদি ডলারে হতো, তাহলে যারা ভারতে আমাদের কাছ থেকে পণ্য কেনে তাদের পণ্যের দাম নির্ধারণে সমস্যায় পড়তে হতো। কিন্তু রুপিতে বাণিজ্য হলে তাদের সেই সমস্যায় পড়তে হবে না। তারা রুপিতে কিনবেন এবং রুপিতে বিক্রি করবেন। ফলে দাম নির্ধারণ করা সহজ হবে। এই ব্যাংকার আরও বলেন, রুপিতে বাণিজ্য আরও সম্প্রসারিত হলে দেশের রিজার্ভের ওপর থেকেও চাপ কমবে।

জানা যায়, রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্য এক বিলিয়ন ডলারের মতো। বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় তৈরি পোশাকসহ কিছু পণ্য রপ্তানি হয়। দেশটি থেকে গম, প্রতিরক্ষা সরঞ্জামাদিসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়ায় ৬৬ কোটি ৫৩ লাখ ডলার মূল্যের বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হয়। একই সময়ে আমদানি হয় ৪৬ কোটি ৬৭ লাখ ডলারের। তবে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের বাইরে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য রাশিয়া থেকে এক হাজার ১৩৮ কোটি ডলারের পণ্য আমদানির এলসি খোলা হয় ২০১৭ সালে। প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। এসব লেনদেন নিষ্পত্তির জন্য রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগেই দেশটির সঙ্গে বিকল্প লেনদেনের একটি মডেল বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় অনুমোদিত হয়।

সেখানে বলা হয়, এক দেশ আরেক দেশে বিপরীত মুদ্রায় অ্যাকাউন্ট খুলবে। বাংলাদেশে থাকবে রাশিয়ান মুদ্রার হিসাব। আর রাশিয়ায় টাকা হিসাব। দেশটির সঙ্গে আমদানি, রপ্তানি ও অন্যান্য বাণিজ্য নিষ্পত্তি হবে নিজ দেশের দুই মুদ্রায়। বাংলাদেশী রপ্তানিকারক এখানে টাকা পাবেন। একইভাবে রাশিয়ান রপ্তানিকারক পাবেন রুবল। উভয় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পর্যায় থেকে লেনদেন নিষ্পত্তির কাজ করা হবে। এভাবে টাকা-রুবলে উভয় দেশের লেনদেন নিষ্পত্তির পর অতিরিক্ত পাওনা মেটানো হবে আন্তর্জাতিকভাবে বিনিময়যোগ্য তৃতীয় মুদ্রায়। এই তৃতীয় মুদ্রা কী হবে দুই দেশ আলোচনার মাধ্যমে তা ঠিক করবে। কিন্তু ওই প্রস্তাব এখনো সরকারি পর্যায়ে অনুমোদন হয়নি। এরমধ্যেই গত শনিবার বাংলাদেশসহ ৩০টির বেশি দেশে রাশিয়ান মুদ্রা ‘রুবল’ ব্যবহার করে বাণিজ্যের অনুমতি দিয়েছে দেশটির সরকার। ফলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখন থেকে রুবলে লেনদেন করতে পারবে। একইসঙ্গে ডেরিভেটিভস বাজারে বাণিজ্যের অনুমতি পাবে বলে জানিয়েছে রাশিয়ার সরকার। 

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, ‘রুবলে বাণিজ্যিক লেনদেন আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে বৈচিত্র্য আনবে। সঙ্গে কিছু বিকল্প বাণিজ্য সুবিধাও তৈরি করবে। তবে রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের আমদানি-রপ্তানি খুব বেশি না। আমদানি-রপ্তানি যদি বেশি হতো তাহলে রুবলে লেনদেন আমাদের জন্য সুবিধা হতো।’ তিনি বলেন, রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের রুবলে লেনদেন বাড়াতে হলে শুরুতে বাণিজ্যিক সমঝোতা বাড়াতে হবে। তিনি আরও বলেন, ‘রুবলে লেনদেন শুধু বাণিজ্য নয়, বিনিয়োগ এবং ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রকেও বিস্তৃত করবে।’ তবে বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন মনে করেন, রুবলে লেনদেনে বাংলাদেশের লাভ বা ক্ষতি কী হবে তা বলার সময় এখনো হয়নি। তিনি বলেন, ‘রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের সর্বোচ্চ আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ৪০০ থেকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের।

রাশিয়ার সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য ঘাটতিও কম। ফলে রুবলে লেনদেনে খুব বেশি লাভ হবে বলে আমি মনে করি না।’ তিনি বলেন, ‘রুবল ডলারের ওপর চাপ কমাতে পারত যদি এটি আন্তর্জাতিক মুদ্রা হতো।’ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘রাশিয়া ৩০টি দেশকে রুবলে বাণিজ্যিক লেনদেনের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। এর জন্য যদি তারা একটি জোট গঠন করত তাহলে আলাদা বিষয় ছিল। কিন্তু রুবলে লেনদেনের বিষয়টি অর্থনৈতিক বিষয়ের চেয়ে রাজনৈতিক বিষয় বেশি। এর মধ্যে অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতি খুব বেশি দেখছি না। তবে এখানে ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থ থাকতে পারে।’ এর আগে গত বুধবার রাশিয়ার উপ-অর্থমন্ত্রী আলেক্সি ময়সিভ এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, রাশিয়া তার বন্ধুদেশগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য সামনের দিনগুলোতে রুবলের ব্যবহার আরও বাড়াবে।
এদিকে ২০১৪ সালের মার্চে একটি প্রজ্ঞাপনে ইউয়ানকে রূপান্তরযোগ্য মুদ্রা হিসেবে ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ। তবে অনেক ব্যাংক আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বা বৈদেশিক লেনদেনে ইউয়ান ব্যবহার না করায় গত বছরের সেপ্টেম্বরে ঋণপত্রের (এলসি) ক্ষেত্রে এবং ব্যাংকের বিদেশী শাখার সঙ্গে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের লেনদেনের সুবিধার্থে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে অ্যাকাউন্ট খুলতে অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে বাণিজ্য ঘাটতি বেশি থাকায় এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না দেশের ব্যাংকগুলো। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাণিজ্য ঘাটতি বেশি থাকায় এ সুযোগ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। চীনা মুদ্রার মজুত বাড়াতে দেশটিতে পণ্য রপ্তানি বাড়ানোর পাশাপাশি ঋণ ও বিনিয়োগের একটা অংশ ইউয়ানে নেওয়া যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ডলারের ওপর নির্ভরতা কমাতে বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।