• শনিবার ১৮ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

  • || ০৯ জ্বিলকদ ১৪৪৫

বাঙালির নতুন হিসেবের খাতা

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১৪ এপ্রিল ২০১৯  

প্রতিনিয়তই যোগ-বিয়োগ ঘটে অনেক ঐতিহ্যের। বিয়োগের খাতাটাই বোধহয় একটু ভারি। তবে কিছু ঐতিহ্যের শিকড় এতটাই শেখরে যে আধুনিকতার শত ঝাঁপটার মধ্যেও দাঁড়িয়ে আছে প্রাচীন বটবৃক্ষের মতো। হালখাতা তেমনই একটি ঐতিহ্য। 

প্রতিটি বাংলা নববর্ষে অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ হিসেবেই আসে ‘হালখাতা’। তবে আমেজ কমলেও এখনো টিকে আছে।

হালখাতা শব্দটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটা লাল মলাটের মোটা খাতা। কিন্তু শুধু একটা খাতাতে হালখাতা শব্দের মাহাত্ম্য শেষ হয়ে যায় না। হালখাতা একটা ঐতিহ্য। হালখাতা একটা রেওয়াজ। হালখাতা একটা উৎসব। সওদাগররা বৈশাখী আমেজ খুঁজেন হালখাতাতেই। খদ্দেররাও মিষ্টিমুখ করতে সকাল সকাল ভীড় জমান বাকি-দোকানে।

সম্রাট আকবরের আমল থেকে ব্যবসায়ীরা এই হালখাতার রেওয়াজ করে আসছে। অতীতে মুদি দোকান থেকে শুরু করে বড় বড় আড়ৎদার, সবার একটা বাকির খাতা থাকতো। বছরের প্রথম দিন সবাই পুরোনো বছরের বাকি চুকিয়ে হিসাব বন্ধ করতো। এজন্য ক্রেতাদের আগের বছরের সকল পাওনা পরিশোধ করার কথা বিনীতভাবে স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়। এ উপলক্ষে নববর্ষের দিন তাদের মিষ্টিমুখ করান ব্যবসায়িরা। তারপরই খোলা হতো নতুন হিসেবের খাতা। এই হালখাতা রেওয়াজ শুধু বাকি পরিশোধ বা দেনা-পাওনার মধ্যেই সীমাদ্ধ নয়। হালখাতার এই উৎসবকে ঘিরে মানুষের মধ্যে হৃদ্যতা বাড়তো। গাঢ় হতো নিত্যদিনের সম্পর্কটিও।

আগের সেই হাল নেই হালখাতার। তবে চিরায়ত এ অনুষ্ঠানটি এখনো হারিয়ে যায়নি। বিশেষ করে স্বর্ণালঙ্কারের দোকানে এই উৎসবের গাঢ় রঙটা দেখা যায়। ঢাকার আদি ব্যবসায়ী পরিবারে মহাসমারোহে পালিত এ রীতিও বেশ জাঁকজমক। পুরান ঢাকার ব্যবসায়ীরা সময় ঘনিয়ে এলেই টাকা পরিশোধের তাগিদ না দিয়ে হালখাতার দাওয়াত দেন। এ উপলক্ষে অনেকে বাহারি কার্ডের ব্যবস্থা করেন। কেউবা মুখে মুখেই সারেন দাওয়াত পর্ব। পুরান ঢাকার হিন্দু পরিবারগুলো পূজার শুভক্ষণ অনুযায়ী লাল মলাটের নতুন খাতা খোলে। বর্তমানে হালখাতার খাবারের আয়োজনে মিষ্টির পাশাপাশি যুক্ত হয়েছে অন্যান্য খাবার। ক্ষীর, হালিম, কোমল পানীয় থেকে শুরু করে অনেকে বিরিয়ানি কিংবা তেহারির ব্যবস্থাও করে থাকেন।

সারাদেশে পহেলা বৈশাখ হালখাতা খুললেও রীতি অনুযায়ী পুরান ঢাকার লক্ষীবাজার, শ্যামবাজার, বাবুবাজার, শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, ইসলামপুর, চকবাজারের দোকানগুলোতে হালখাতার আয়োজন করা হয় তার পরদিন। তবে তাদের প্রস্তুতি থাকে পুরো মাসজুড়ে। ধোয়া-মোছা ও হিসাব-নিকাশের কাজ। আবার কেউ নতুন বছর উপলক্ষে পুরো দোকানেই নতুনত্ব আনার জন্য পুরোনো জিনিসপত্র রং করার কাজে ব্যস্ত থাকেন। দোকানগুলো সাজানো হয় বৈশাখ উদযাপনের নানা উপকরণ দিয়ে। মুখোশ, ঘুড়ি, বৈশাখী টুপি, একতারা, ডুগডুগি দিয়ে দোকান সাজান ব্যবসায়ীরা।

ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিচর্চার প্রতিষ্ঠান ‘ঢাকা কেন্দ্র’ এর পরিচালক পুরান ঢাকা বিশেষজ্ঞ আজিম বখ্শ ষাট-সত্তর দশকের হালখাতা প্রসঙ্গে বলেন, ‘শুরু থেকেই এটা ব্যবসায়ীদের উৎসব। সেসময়ে পুরান ঢাকায় হিন্দু ব্যবসায়ীরা, বিশেষ করে পাইকারি ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেশ আড়ম্বরে হালখাতা করার প্রবণতা ছিল। সেটি ছিল লাল সালু কাপড়ের মলাটে মোড়ানো লাল রঙের একটি খাতা। আমি দেখেছি, হিন্দু ব্যবসায়ীরা পুরোনো খাতা বাদ দিয়ে পয়লা বৈশাখে হালখাতা শুরুর আগে নতুন খাতাটি নিয়ে ঢাকেশ্বরী মন্দিরে যেতেন। পূজা দিতেন। পূজারিরা সিঁদুরের মধ্যে কাঁচা পয়সা ডুবিয়ে ওসই পয়সা সিলমোহরের মতো ব্যবহার করে নতুন খাতায় ছাপ মেরে তা উদ্বোধন করতেন। যখন থেকে মুসলিম ব্যবসায়ীদের আধিক্য বাড়ে, সে সঙ্গে এই উৎসব ফিকে হওয়া শুরু করে।’

দীর্ঘ ৪৭ বছর ধরে সালু-খাতা তৈরি করেন পুরান ঢাকার বাংলাবাজার এলাকার লোকনাথ বুক এজেন্সি। প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার সাইদুজ্জামান জানান, আগে হালখাতার ব্যাপক চাহিদা থাকলেও এখন তেমন চাহিদা নেই। হালখাতা বিক্রি হয় যৎসামান্য। মূলত আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে মানুষ আস্তে আস্তে হালখাতা ব্যবহার থেকে সরে আসছে। দিন যত যাচ্ছে হালখাতার ভবিষ্যত ততই অন্ধকার বলে তিনি মনে করেন।

পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী দীপন নন্দি বলেন, মানুষের হাতে এখন কাড়ি কাড়ি টাকা। আগের মতো বাকি করতে হয়না। শহওে কেন, গ্রামেও এ জিনিসটা লক্ষণীয়। এ কারণেও হালখাতা রেওয়াজটা কমে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।’