• সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

  • || ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

তাকদিরে বিশ্বাস ও আল্লাহর ফায়সালায় সন্তুষ্টি ঈমানের দাবি (পর্ব-১)

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ৪ এপ্রিল ২০২০  

তাকদির ও ভাগ্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত। মানুষের জীবনে যা ঘটে আল্লাহর পক্ষ থেকেই হয়। এরূপ বিশ্বাস রাখাই হচ্ছে তাকদিরের দাবি। তাকদির নিয়ে কোনো বিতর্কে জড়ানোও মুমিনদের কাম্য নয়। এখানে আল্লাহ তায়ালার এক বিশাল রহস্য লুকিয়ে আছে। 

এক হাদিসে রাসূল কারিম (সা.) উল্লেখ করেন, 

وَإِنْ أَصَابَكَ شَيْءٌ، فَلَا تَقُلْ لَوْ أَنِّي فَعَلْتُ كَانَ كَذَا وَكَذَا، وَلَكِنْ قُلْ قَدَرُ اللهِ وَمَا شَاءَ فَعَلَ، فَإِنَّ لَوْ تَفْتَحُ عَمَلَ الشَّيْطَانِ

‘যদি পার্থিব জীবনে কখনো বিপদ ও মসিবতে আক্রান্ত হও তখন এটা বলো না যে, যদি এরূপ করতাম তাহলে এটা হত না, যদি ওটা করতাম তাহলে এরূপ হত। এই ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’ শব্দ বাদ দাও। বরং বলো আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা এবং ফয়সালা এটাই ছিল। আল্লাহ তায়ালা যা চেয়েছেন তাই হয়েছে। কারণ যদি শব্দটি শয়তানকে কাজ করার পথ উন্মুক্ত করে দেয়।’ 

যেমন : কোনো প্রিয়জনের ইন্তেকাল হলে তুমি বললে, যদি অমুক ডাক্তার দ্বারা চিকিৎসা করাতাম তা হলে সে বেঁচে যেত কিংবা কারো মাল চুরি হয়েছে কিংবা কোনো ঘরে ডাকাতি হয়েছে, তখন এই কথা বলা যে, যদি এভাবে হেফাজত করতাম তা হলে চুরি বা ডাকাতি হত না। এরূপ কথা বলো না বরং বলো, এরূপ হওয়াই আল্লাহ তায়ালার ফয়সালা এবং ইচ্ছা ছিল তাই এরূপ হয়েছে। আমি হাজার চেষ্টা করেও এ বিপদকে রুখতে পারতাম না।

দুনিয়াতে আরামও আছে, কষ্টও আছে :

এক হাদিসে বড় আশ্চর্য শিক্ষা দান করা হয়েছে। তা হলো, এ দুনিয়াতে শান্তি, সুস্থতা, আরাম ও প্রশান্তি লাভ করার একমাত্র পথ হলো মানুষ তাকদিরের প্রতি বিশ্বাস ও ঈমান রাখবে। কোনো মানুষই এমন নেই, যে দুনিয়াতে কখনো দুঃখ-কষ্ট ও পেরেশানির শিকার হয়নি কিংবা কোনো মসিবতে আক্রান্ত হয়নি। দুনিয়ার এ জীবন সুখ ও দুঃখ উভয় মিলেই। এ জীবনে খুশিও আছে, দুঃখও আছে, আরামও আছে, কষ্টও আছে, এখানে কোনো আনন্দই অমলিন নয়, কোনো দুঃখই নিরানন্দ নয়। তাই দুঃখ-বেদনা এবং কষ্ট ও পেরেশানি পার্থিব জীবনে অবশ্যই আসবে। যদি সারা পৃথিবীর সম্পদ ব্যয় করেও চাও যে, কোনো কষ্ট আসবে না, এটা হতে পারে না।

আল্লাহর প্রিয় যারা, দুঃখ-কষ্ট তাদের ওপর বেশি আসে :

আমাদের হিসেব তো অনেক দূরে। আমবিয়ায়ে কেরাম ছিলেন আল্লাহ তায়ালার প্রিয় ও পছন্দনীয় মাখলুক। তাদের ওপরও দুঃখ-কষ্ট ও পেরেশানি আসত এবং সাধারণ মানুষদের চেয়ে বেশিই আসত। তাই তো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন,

أَشَدُّ النَّاسِ بَلاَءً الأَنْبِيَاءُ، ثُمَّ الأَمْثَلُ فَالأَمْثَلُ

মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুঃখ-কষ্টের শিকার হয়েছেন আমবিয়ায়ে কেরাম। এরপর যারা আম্বিয়ায়ে কেরামের যত নিকটতম তাদের ওপর তত বেশি কষ্ট ও পেরেশানি আসে। (কানযুল উম্মাল)। যে জগতে কোনো কষ্ট ও পেরেশানি নেই সেটা হলো জান্নাত। তাই এ দুনিয়াতে দুঃখ-কষ্ট আসলে এরূপ ভাবা উচিত নয় যে, কেন এ দুঃখ-কষ্ট আসল? যদি এরূপ করতাম তা হলে এ সমস্যা হত না, অমুক কারণে এরূপ হয়ে গেছে। এভাবে চিন্তা করার দ্বারা আক্ষেপ ও হতাশাই বৃদ্ধি পায় এবং আল্লাহ তায়ালার ওপর অভিযোগ তৈরি হয়। এর ফলে দুনিয়াতেও কষ্ট হয় এবং অভিযোগের কারণে পরকালেও সে শাস্তির উপযুক্ত হবে। অনেক সময় ঈমান হারানোর ভয়ও তৈরি হয়।

ছোট পোঁকা ফায়েদার কথা কি জানে?

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, যখন কোনো পেরেশানি বা দুঃখ-কষ্ট দেখা দেয় তখন মনে কর আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ও নির্দেশেই এ পেরেশানি এসেছে। আমি এর হেকমত কি জানি? আল্লাহ তায়ালাই এর হেকমত ও ফায়েদা জানেন। একটি তুচ্ছ কীট তাঁর হেকমত ও কৌশল সম্পর্ক কি জানে? কতটুকু জানে? হ্যাঁ, কষ্টের কারণে যদি চোখে পানি আসে এতে কোনো সমস্যা নেই। মানুষের মাঝে প্রচলিত আছে, কষ্ট পেলে কাঁদা উচিত নয় একটা ভুল কথা। কেননা কষ্ট পেলে কাঁদা খারাপ নয়। তবে শর্ত হলো আল্লাহ তায়ালার ওপর যেন কোনো অভিযোগ না হয়।

ক্ষুধার কারণে এক বুজুর্গের কান্না :

এক বুজুর্গের ঘটনা। এক ব্যক্তি তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়ে দেখেন তিনি বসে বসে কাঁদছেন। লোকটি জিজ্ঞাসা করল, হজরত, কি কারণে কাঁদছেন? বুজুর্গ ব্যক্তিটি বললেন, খুব ক্ষুধা পেয়েছে। লোকটি বলল, আপনি কি কোনো শিশু যে, ক্ষুধার কারণে কাঁদছেন? ক্ষুধার কারণে তো শিশুরা কাঁদে, আপনি তো বড় মানুষ আপনিও কাঁদছেন। বুজুর্গ ব্যক্তিটি বলেন, তুমি কি জান? আলাহ তায়ালা আমার কান্না দেখতে চান। এ জন্যই তো তিনি আমাকে ক্ষুধার্ত রেখেছেন। অনেক সময় কান্নাও আল্লাহর কাছে পছন্দনীয় হয়। তবে শর্ত হলো, কান্নার সঙ্গে অভিযোগ ও অনুতাপ যেন না থাকে। সুফিয়ায়ে কেরামের পরিভাষায়, একেই তাফবিয বলা হয়। অর্থাৎ কোনো বিষয়কে আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দেয়া এবং এ কথা বলা যে, হে আল্লাহ, বাহ্যিকভাবে আমার কষ্ট হচ্ছে কিন্তু আপনার ফয়সালা সঠিক। আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছা ও নির্দেশ ছাড়া বৃক্ষের একটি পাতাও নড়ে না এবং সব ফয়সালা আল্লাহর পক্ষ থেকে হয়। এ কথার ওপর যদি মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস অর্জিত হয়, তাহলে এ বিশ্বাসের দৃঢ়তা তাকে প্রশান্তি ও সুখ এনে দেয় এবং পেরেশানি ও অসুস্থ অবস্থায় অসহনীয় কষ্ট থেকে তাকে বাঁচিয়ে দেয়।

মুসলমান ও কাফেরের মধ্যকার পার্থক্য :

একজন কাফেরের প্রিয়জন অসুস্থ হলো। সে তাকে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেল। চিকিৎসা অবস্থায় সে মারা গেল। এ অবস্থায় কাফের লোকটির কাছে সান্তনা লাভের কোনো রাস্তা নেই। সে ভাববে, ডাক্তার সঠিক ওষুধ নির্বাচনে ব্যর্থ হয়েছে, সঠিক চিকিৎসা না হওয়ায় সে মারা গেল, যদি সঠিক চিকিৎসা হত তাহলে সে মারা যেত না। পক্ষান্তরে একজন মুসলমানের প্রিয়জন অসুস্থ হলো। ডাক্তারের চিকিৎসা অবস্থায় সে মারা গেল। এ মুসলমানের কাছে সান্তনা লাভের উপকরণ আছে। সে ভাববে, যদিও তার মৃত্যুর পেছনে বাহ্যিক কারণ ডাক্তারের উদাসীনতা কিন্তু যা কিছু হয়েছে আল্লাহর ইচ্ছায় হয়েছে। তার মৃত্যু নির্ধারিত সময়েই হয়েছে। যদি ডাক্তার সঠিক ওষুধও দিত তা হলেও মৃত্যু হত। আমি যদি এ ডাক্তার ছাড়া অন্য কোনো ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতাম তখনও মৃত্যু হত। কারণ আল্লাহ তায়ালা মানুষের ভাগ্যে যা লিখে রেখেছেন সেটা যথাসময়ে ঘটবেই। তার হায়াত শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই সে চলে গেছে।
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসুদ রাদি. একজন বিশিষ্ট সাহাবি ছিলেন। তিনি বলেন, আমি আগুনের একটি অঙ্গার মুখে নিয়ে চুষব, এটা আমি মেনে নিতে পারি কিন্তু যে ঘটনা ঘটে গেছে তা সম্পর্কে বলব, আহ! এটা যদি না হত কিংবা যে ঘটনা ঘটেনি সে সম্পর্কে বলব, ইস! এটা যদি হত, এটা আমি মেনে নিতে পারি না।

আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাক :

হজরত আবদুলাহ ইবনে মাসউদ রাদি. এর কথার মর্ম হলো, আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো বিষয়ের ফয়সালা করেন এবং সে অনুযায়ী যখন কোনো ঘটনা ঘটে তখন সে সম্পর্কে এটা না হলে ভালো হত কিংবা এটা হলে ভালো হত, এ কথা বলা আল্লাহ তায়ালার তাকদিরের ওপর সন্তুষ্ট হওয়ার খেলাফ। আল্লাহ তায়ালার তাকদির এবং তাঁর ফয়সালায় সন্তুষ্ট থাকা এবং তাকদিরের ফয়সালার ওপর মনে কোনো অভিযোগ সৃষ্টি না হওয়া একজন মুমিনের কাছে দাবি। বরং হৃদয় ও মন থেকে তাঁর ওপর সন্তুষ্ট থাকাই কাম্য। অন্য একটি হাদিসে হজরত আবু দারদা রাদি. বলেন,
 
اذا قضي الله قضاء احب ان يرضي بقضاءه

আল্লাহ তায়ালা যখন কোনো বিষয়ে ফয়সালা করেন তখন মুমিন ব্যক্তি তাতে সন্তুষ্ট থাকবে এবং বিনা দ্বিধায় তা মেনে ননেবে, আল্লাহ তায়ালা এটা পছন্দ করেন। (কিতাবুয যুহদ)।

ধরুন, কোনো কষ্টদায়ক বা দুঃখজনক ঘটনা ঘটলে এই কথা বলা যে, যদি এরূপ করতাম তা হলে ঘটনাটি ঘটত না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ বলতে নিষেধ করেছেন। কারণ যা ঘটেছে তা ঘটারই ছিল। আল্লাহ তায়ালার ফয়সালা এরূপই ছিল। আমরা হাজার চেষ্টা করেও তা পরিবর্তন করতে পারতাম না। তাই এ ধরনের কথা বলা থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে; অর্থহীন কথা বলা মুমিনের কাজ নয়।

আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্টির মাঝে সান্তনার উপকরণ আছে :

গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, তাকদিরের ফয়সালায় সন্তুষ্ট হওয়া ছাড়া মানুষের কাছে কিছুই নেই। কারণ মানুষের অসন্তুষ্ট হওয়ার দ্বারা ফয়সালা পরিবর্তন হয় না। আমরা যে দুঃখ-বেদনার স্বীকার হই, অসন্তুষ্ট হওয়ার দ্বারা তা দূর হয় না। বরং অসন্তুষ্ট হওয়াতে দুঃখের প্রচণ্ডতা এবং কষ্টের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। চিন্তা করলে দেখা যায়, আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট হওয়ার মধ্যে মানুষের জন্য সান্তনার উপকরণ রয়েছে।

তাকদির তদবিরের দ্বারা পরিবর্তন হয় না :

তাকদির একটি বিস্ময়কর আকিদা। এ আকিদাকে সঠিকভাবে না বুঝার কারণে মানুষ বিভিন্ন রকম ভুলের মধ্যে পড়ে যায়। প্রথম কথা হলো, কোনো ঘটনা ঘটার আগে তাকদিরের আকিদার ওপর নির্ভর করে কর্মহীন বসে থাকা যাবে না। এ কথা বলার সুযোগ নেই যে, তাকদিরে যা লেখা আছে তা তো ঘটবেই, আমি কিছুই করব না। ব্যস, তাকদিরের বাহানায় হাত গুটিয়ে কর্মহীন বসে থাকল, এটা রাসূল সালাল াহু আলাইহি ওয়াসালামের শিক্ষা নয়। বরং রাসূলুল্লাহ সালালাহু আলাইহি ওয়াসালামের নির্দেশ হলো, যে জিনিস অর্জনের জন্য যে ধরনের তদবির ও চেষ্টা-প্রচেষ্টা প্রয়োজন তা অবলম্বন কর; তদবির অবলম্বনে কোনো ধরনের ত্রুটি করবে না।

তদবিরের পর ফয়সালা আল্লাহর হাতে ছেড়ে দাও :

দ্বিতীয় কথা হলো, কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তাকদিরের আকিদার ওপর আমল শুরু হয়। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর মুমিনের কাজ হলো, সে চিন্তা করবে, আমার যা করার ছিল তা আমি করেছি, আমার চেষ্টা-প্রচেষ্টা সত্তেও এবং তদবিরের ত্রুটি না থাকা সত্তেও যা ঘটেছে এটা আল্লাহ তায়ালার ফয়সালা ছিল। আমি আল্লাহর ফয়সালায় সন্তুষ্ট। তাই ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর তার জন্য বেশি পেরেশান হওয়া, খুব দুঃখ পাওয়া কিংবা কষ্ট প্রকাশ করা কিংবা আমি যদি অন্যভাবে চেষ্টা করতাম তা হলে এরূপ হত, এ ধরনের কথা বলা তাকদিরের আকিদার খেলাফ। ঘটনা ঘটার আগে তাকদিরের ওপর নির্ভর করে কর্মহীন বসে থাকা এবং ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে বেশি পেরেশান হওয়া এতদুভয়ের মাঝে আল্লাহ তায়ালা মধ্যপন্থা নির্দেশ করেছেন যে, যতক্ষণ পর্যন্ত ঘটনা ঘটেনি ততক্ষণ পর্যন্ত তোমাদের দায়িত্ব হলো নিজের সম্পূর্ণ চেষ্টা ও মেহনত ব্যয় করা এবং সর্তকতামূলক পদক্ষেপও গ্রহণ করা। কারণ তাকদিরে কি আছে এটা জানা নেই।
চলবে...