• সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

  • || ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

কোরআনের দৃষ্টিতে প্রকৃত সৎকর্মশীলদের পরিচয়

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১০ এপ্রিল ২০২০  

ইসলাম ধর্মে ঈমানের পর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য ইবাদত হলো সালাত ও জাকাত। পবিত্র কোরআনুল কারিমের বহু স্থানে সালাত-জাকাতের আদেশ করা হয়েছে এবং আল্লাহর অনুগত বান্দাদের জন্য অশেষ সওয়াব, রহমত ও মাগফিরাতের পাশাপাশি আত্মশুদ্ধিরও প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। 

মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা কোরআনের এক আয়াতে ইরশাদ করেছেন,

وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ ؕ وَ مَا تُقَدِّمُوْا لِاَنْفُسِكُمْ مِّنْ خَیْرٍ تَجِدُوْهُ عِنْدَ اللّٰهِ ؕ اِنَّ اللّٰهَ بِمَا تَعْمَلُوْنَ بَصِیْرٌ

‘তোমরা সালাত আদায় কর এবং জাকাত প্রদান কর। তোমরা যে উত্তম কাজ নিজেদের জন্য অগ্রে প্রেরণ করবে তা আল্লাহর নিকটে পাবে। নিশ্চয়ই তোমরা যা কর আল্লাহ তা দেখছেন। (সূরা: বাকারা, আয়া: ১১০)।

অন্য আয়াতে রাব্বুল আলামিন আল্লাহ ইরশাদ করেন,

وَ اَقِیْمُوا الصَّلٰوةَ وَ اٰتُوا الزَّكٰوةَ وَ اَطِیْعُوا الرَّسُوْلَ لَعَلَّكُمْ تُرْحَمُوْنَ

‘তোমরা সালাত আদায় কর, জাকাত দাও এবং রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা অনুগ্রহভাজন হতে পার।’(সূরা: নূর, আয়াত: ৫৬)।

সূরা নিসার ১৬২ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের জন্য ‘আজরুন আযীম’ এর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ইরশাদ করেছেন,

وَ الْمُقِیْمِیْنَ الصَّلٰوةَ وَ الْمُؤْتُوْنَ الزَّكٰوةَ وَ الْمُؤْمِنُوْنَ بِاللّٰهِ وَ الْیَوْمِ الْاٰخِرِ ؕ اُولٰٓىِٕكَ سَنُؤْتِیْهِمْ اَجْرًا عَظِیْمًا۠

‘এবং যারা সালাত আদায় করে, জাকাত দেয় এবং আল্লাহ ও পরকালে ঈমান রাখে আমি তাদেরকে মহাপুরস্কার দেব।’

অন্য আয়াতে জাকাতের গুরুত্বপূর্ণ সুফল বর্ণনা করে আল্লাহ তায়ালা বলেন,

خُذْ مِنْ اَمْوَالِهِمْ صَدَقَةً تُطَهِّرُهُمْ وَ تُزَكِّیْهِمْ بِهَا وَصَلِّ عَلَیْهِمْ ؕ اِنَّ صَلٰوتَكَ سَكَنٌ لَّهُمْ ؕ وَ اللّٰهُ سَمِیْعٌ عَلِیْمٌ

‘তাদের সম্পদ থেকে সদকা গ্রহণ করুন, যার দ্বারা আপনি তাদেরকে পবিত্র করবেন এবং পরিশোধিত করবেন এবং আপনি তাদের জন্য দোয়া করবেন। আপনার দোয়া তো তাদের জন্য চিত্ত স্বস্তিকর। আল্লাহ সর্বশ্রোতা, সর্বজ্ঞ।’(সূরা: তাওবা, আয়াত: ১০৩)।

এছাড়া পবিত্র কোরআনুল কারিমের বিভিন্ন আয়াত থেকে পরিষ্কার জানা যায় যে, সালাত ও জাকাতের পাবন্দী ছাড়া আল্লাহর নৈকট্য অর্জনের প্রশ্নই অবান্তর। কোরআন মজিদের বিভিন্ন আয়াতে, যেখানে খাঁটি মুমিনের গুণ ও বৈশিষ্ট্য উল্লেখিত হয়েছে সেখানে সালাত-জাকাতের কথা এসেছে অপরিহার্যভাবে।

এমনিভাবে পবিত্র কোরআনুল কারিমে পঞ্চাশেরও অধিক আয়াতে সালাত (নামাজ) প্রতিষ্ঠা করা ও জাকাত দেয়ার কথা এসেছে। এটা কোরানের একটা সূত্র। যারা এ সূত্র মেনে চলেন তাদের জীবনই সফল জীবন হবে---এমন আশ্বাসও রয়েছে কোরানে। 

দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হয় এবং বছরে একবার সঞ্চিত সম্পদের ২.৫ শতাংশ জাকাত দিতে হয় (শস্য-ফল/পশুর জাকাতও বিবেচনায় থাকলো)। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সারা জীবন ধরে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে গেলেই এবং বছরে একবার জাকাত দিয়ে গেলেই একজনের জীবন কিভাবে সফল হয়ে যায়?

এর সদুত্তর পেতে হলে সালাত ও জাকাত শব্দের মূল অর্থের দিকেও নজর দিতে হয়। সালাতের বিভিন্ন তাৎপর্যের মধ্যকার একটা তাৎপর্য হচ্ছে ‘যুক্ত হওয়া’। আর জাকাতের দু’টি তাৎপর্যের একটি হচ্ছে ‘দান করা’ এবং অন্যটি ‘পবিত্র হওয়া’।

সালাত : 

যুক্ত হতে হয় কাদের সঙ্গে? যুক্ত হতে হয় আল্লাহর সঙ্গে, মানুষের সঙ্গে ও সার্বিকভাবে জগতের সঙ্গে। 

যুক্ত হওয়ার অর্থ কী? 

আল্লাহর সঙ্গে যুক্ত হওয়ার অর্থ হচ্ছে আল্লাহ ছাড়া আর কারও উপাসনা না করা, আর কিছুকে জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য/উদ্দেশ্য হিসেবে না নেয়া, আল্লাহকে জীবনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করা, আল্লাহ সম্বন্ধে সচেতন থেকে মূল্যবোধগুলোকে সদিচ্ছাসহ অবলম্বন করা, আল্লাহর শাস্তিকে ভয় করা।

মানুষের সঙ্গে যুক্ত হবার অর্থ হচ্ছে গর্ভজাত ও সামাজিক সম্পর্ক বজায় রাখা, মানুষকে সম্মান করা, ভালবাসা, তাদের প্রতি ন্যায়বিচার করা, তাদের প্রতি যত্নশীল থাকা।

জগতের সঙ্গে যুক্ত হবার অর্থ হচ্ছে প্রকৃতিকে সর্বনিম্নসম্ভব আলোড়িত করা, প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিনষ্ট না করা, প্রকৃতির জিনিসপত্র প্রয়োজনের অতিরিক্ত ব্যবহার না করা, প্রয়োজনকে সীমিত রাখা, অপচয় না করা।

জাকাত :

জাকাত সব ধরনের বৌদ্ধিক-দৈহিক সামর্থ্য ও আর্থিক সম্পদে অন্যদেরকে অংশীদার করা। কোরান-হাদিসে ‘জাকাত’ এর সমার্থক আর যে দু’টি পরিভাষা আছে তা হলো ‘সাদাকা’ ও ‘এহসান’। জাকাতের মধ্যে ‘আত্মশুদ্ধি’ সংজ্ঞা রয়েছে, সাদাকার মধ্যে আছে ‘সত্য’ সংজ্ঞা, আর ‘এহসান’ এর মধ্যে আছে ‘সুন্দর সংজ্ঞা।

সত্য হচ্ছে তা-ই যা টিকে থাকে, যার বিনাশ নেই। সুন্দর হচ্ছে দর্শকের একটি মানসিক অবস্থা যা তাকে মুগ্ধ করে, আনন্দিত করে। সাদাকা বলতে শুধু সম্পদ খরচ করাকে বোঝায় তা নয়। অন্যের জন্য আন্তরে বিদ্যমান শুভ ও কল্যাণ ইচ্ছা, মুখের হাসি, সম্মানজনক কথা, মমত্বপূর্ণ সাড়া, নিজের ক্ষতি মেনে নিয়ে হলেও ন্যায্য সিদ্ধান্ত নেয়া---এ সবই সাদাকা।

এহসান হচ্ছে অন্যের প্রয়োজন পূরণের জন্য, তার কল্যাণের জন্য ত্যাগমূলক কাজ এমনভাবে সম্পাদন করা যা গ্রহীতা ও অন্য দর্শকদের কাছে সুন্দর বলে উদ্ভাসিত হয়। একাজের সঙ্গে অহংকার, প্রদর্শনেচ্ছা, প্রতিদানের প্রত্যাশা, প্রত্যাশিত প্রতিদান না পেলে খোটা দেয়া ইত্যাদি জড়িয়ে গেলে বিষয়টা আর সুন্দর থাকে না। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, জনপ্রিয় হওয়ার উদ্দেশ্যে দান করা, মানুষের কাছ থেকে বেশি কাজ পাওয়ার আশায় তাকে দান করা, প্রত্যাশিত কাজ না পেলে তার প্রতি বিরূপ-বিরক্ত হওয়া, তাকে খোটা দেয়া---এসব দানমূলক কাজকে অসুন্দর করে দেয়।

কোরানের এই সালাত-জাকাতের নীতিটিই আরো দু’ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। (১) ‘যারা ঈমান এনেছে ও আমলে সালেহ করেছে---তারাই সফলকাম’; (২) ‘তুমি আল্লাহর উদ্দেশ্যে সালাত আদায় কর ও কোরবানি কর’।

ঈমান হচ্ছে অন্তরের একটি অবস্থা যার প্রকৃত রূপ অন্যদের কাছে চূড়ান্ত বিচারে অপ্রকাশিতই থেকে যায়। এই ঈমান হচ্ছে আল্লাহ, মানুষ ও জগতের প্রতি একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি, একটি বিশেষ হাল, দশা বা অবস্থা। এদিক থেকে বিবেচনা করলে ঈমান হচ্ছে সম্পর্ক বা সংযুক্তি আর আমলে সালেহ হচ্ছে জাকাত, সাদাকা, এহসান। আর জাকাত, সাদাকা ও এহসান হচ্ছে কোরবানি বা আত্মত্যাগ।

কোরআনের দৃষ্টিতে প্রকৃত সৎকর্মশীলদের পরিচয় যেখানে দেয়া হয়েছে সেখানে সালাত-জাকাতের উল্লেখ এসেছে। সূরা বাকারা ১৭৭ নম্বর আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, 

لَّيْسَ الْبِرَّ أَن تُوَلُّواْ وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَـكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَالْمَلآئِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَى وَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّآئِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُواْ وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاء والضَّرَّاء وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَـئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَـئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ

‘সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হলো এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর ওপর কিয়ামত দিবসের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর এবং সমস্ত নবী-রাসূলদেরর ওপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তাঁরই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, এতীম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। আর যারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করে, জাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারণকারী তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেযগার।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১৭৭)।

ইয়া রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা! সব মুসলিম উম্মাহকে কোরআন-হাদিসের নির্দেশানুযায়ী সালাত ও জাকাতের প্রতি যত্নশীল হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।