• সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

  • || ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

কোরআনে যে কারণে আবু লাহাব ও তার স্ত্রীর নিন্দা করা হয়েছে

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১৮ এপ্রিল ২০২০  

সূরা আল লাহাব (আরবি: سورة اﻟﻠﻬﺐ‎‎) পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআনের ১১১ তম সূরা। এর আয়াত সংখ্যা ৫ এবং সূরাটি মক্কায় অবতীর্ণ হয়েছে।

আরবি উচ্চারণ : بِسْمِ اللہِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِیْم

বাংলা উচ্চারণ : বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম

অনুবাদ : পরম করুণাময় অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে (শুরু করছি)

(১) 
আরবি উচ্চারণ : تَبَّتْ يَدَا أَبِي لَهَبٍ وَتَبَّ

বাংলা উচ্চারণ : তাব্বাত ইয়াদা আবি লাহাবিও ওয়া তাব্ব।

অনুবাদ : ধ্বংস হোক আবু লাহাবের হস্তদ্বয় এবং ধ্বংস হোক সে নিজেও।

(২) 
আরবি উচ্চারণ : مَا أَغْنَى عَنْهُ مَالُهُ وَمَا كَسَبَ

বাংলা উচ্চারণ : মা আগনা-আনহু মা-লুহু ওয়ামা-কাসাব্।

অনুবাদ : তার ধন-সম্পদ আর সে যা অর্জন করেছে তা তার কোন কাজে আসল না।

(৩) 
আরবি উচ্চারণ : سَيَصْلَى نَارًا ذَاتَ لَهَبٍ

বাংলা উচ্চারণ : সাইয়াছলা-না-রান যা-তা লাহাবিও।

অনুবাদ : অচিরেই সে শিখা বিশিষ্ট জাহান্নামের আগুনে প্রবেশ করবে,

(৪) 
আরবি উচ্চারণ : وَامْرَأَتُهُ حَمَّالَةَ الْحَطَبِ

বাংলা উচ্চারণ : ওয়ামরাআতুহু; হাম্মা-লাতাল হাত্বাব।

অনুবাদ : আর তার স্ত্রীও- যে কাঠবহনকারিণী (যে কাঁটার সাহায্যে নবী-কে কষ্ট দিত এবং একজনের কথা অন্যজনকে ব’লে পারস্পরিক বিবাদের আগুন জ্বালাত।

(৫) 
আরবি উচ্চারণ : فِي جِيدِهَا حَبْلٌ مِّن مَّسَدٍ

বাংলা উচ্চারণ : ফী জ্বীদিহা-হ্বাবলুম মিম মাসাদ্।

অনুবাদ : আর (দুনিয়াতে তার বহনকৃত কাঠ-খড়ির পরিবর্তে জাহান্নামে) তার গলায় শক্ত পাকানো রশি বাঁধা থাকবে। (সূরা : আল লাহাব, আয়াত : ১-৫)।

আবু লাহাবের আসল নাম ছিল আবদুল ওয্‌যা। সে ছিল আবদুল মোত্তালিবের অন্যতম সন্তান। গৌরবর্ণের কারণে তার ডাক নাম হয়ে যায় আবু লাহাব। কোরআন পাক তার আসল নাম বর্জন করেছে। কারণ সেটা মুশরিকসুলভ। এছাড়া ‘আবু লাহাব’ ডাক নামের মধ্যে জাহান্নামের সঙ্গে বেশ মিলও রয়েছে। সে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর কট্টর শত্রু ও ইসলামের ঘোর বিরোধী ছিল এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে কষ্ট দেয়ার প্রয়াস পেত। তিনি যখন মানুষকে ঈমানের দাওয়াত দিতেন, তখন সে সঙ্গে সঙ্গে যেয়ে তাকে মিথ্যাবাদী বলে প্রচার করত।

নামকরণ :

প্রথম আয়াতের লাহাব শব্দকে এ সূরার নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

নাজিলের সময়-কাল :

এর মক্কী হবার ব্যাপারে তাফসীরকারদের মধ্যে কোনো মতবিরোধ নেই। কিন্তু মক্কী যুগের কোন সময় এটি নাজিল হয়েছিল তা যথাযথভাবে চিহ্নিত করা কঠিন। তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর ইসলামি দাওয়াতের বিরুদ্ধে আবু লাহাবের যে ভূমিকা এখানে দেখা গেছে তা থেকে আন্দাজ করা যেতে পারে যে, এ সূরাটি এমন যুগে নাজিল হয়ে থাকবে যখন রাসূলের (সা.) সঙ্গে শত্রুতার ক্ষেত্রে সে সীমা পেরিয়ে গিয়েছিল এবং তার দৃষ্টিভঙ্গী ও কর্মনীতি ইসলামের অগ্রগতির পথে একটি বড় বাধার সৃষ্টি করেছিল।

সম্ভবত কুরাইশরা যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর বংশের লোকদেরকে সামাজিকভাবে বয়কট করে তাদের শে’ বে আবু তালেবে (আবু তালেব গিরিপথ) অন্তরীণ করেছিল এবং একমাত্র আবু লাহাবই তার বংশের লোকদেরকে পরিত্যাগ করে শত্রুদের সঙ্গে অবস্থান করছিল, তখনই এ সূরাটি নাজিল হওয়া বিচিত্র নয়। আমাদের এ অনুমানের ভিত্তি হচ্ছে, আবু লাহাব ছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা। আর ভাতিজার মুখে চাচার প্রকাশ্যে নিন্দাবাদ ততক্ষণ সংগত হতে পারতো না যতক্ষণ চাচার সীমা অতিক্রমকারী অন্যায়, জুলম ও বাড়াবাড়ি উন্মুক্তভাবে সবার সামনে না এসে গিয়ে থাকে। এর আগে যদি শুরুতেই এ সূরাটি নাজিল করা হতো তাহলে লোকেরা নৈতিক দিক দিয়ে একে ত্রুটিপূর্ণ মনে করতো। কারণ ভাতিজার পক্ষে এভাবে চাচার নিন্দা করা শোভা পায় না।

পটভুমি :

কোরআনে মাত্র এ একটি জায়গাতেই ইসলামের শত্রুদের কারো নাম নিয়ে তার নিন্দা করা হয়েছে। অথচ মক্কায় এবং হিজরতের পরে মদিনায়ও এমন অনেক লোক ছিল যারা ইসলাম ও মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শত্রুতার ক্ষেত্রে আবু লাহাবের চাইতে কোনো অংশে কম ছিল না। প্রশ্ন হচ্ছে, এ ব্যক্তিটির এমনকি বিশেষত্ব ছিল যে কারণে তার নাম নিয়ে নিন্দা করা হয়েছে? একথা বুঝার জন্য সমকালীন আরবের সামাজিক অবস্থা অনুধাবন এবং সেখানে আবু লাহাবের ভূমিকা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।

প্রাচীন যুগে যেহেতু সারা আরব দেশের সব জাযগায় অশান্তি, বিশৃংখলা, লুটতরাজ ও রাজনৈতিক অরাজকতা বিরাজ করছিল এবং শত শত বছর থেকে এমন অবস্থা চলছিল যার ফলে কোনো ব্যক্তির জন্য তার নিজের বংশ ও রক্তসম্পর্কের আত্মীয় - পরিজনের সহায়তা ছাড়া নিজের ধন প্রাণ ও ইজ্জত - আবরুর হেফাজত করা কোনোক্রমেই সম্ভবপর ছিল না। এ জন্য আরবীয় সমাজের নৈতিক মূল্যবোধের মধ্যে আত্মীয় - স্বজনদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার ছিল অত্যন্ত গুরুত্বের অধিকারী। আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করাকে মহাপাপ মনে করা হতো। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন ইসলামের দাওয়াত নিয়ে এগিয়ে এলেন তখন আরবের ওই প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রভাবে কুরাইশ গোত্রের অন্যান্য পরিবার ও তাদের সরদাররা তাঁর কঠোর বিরোধিতা করলেও বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিব (হাশেমের ভাই মুত্তালিবের সন্তানরা) কেবল তাঁর বিরোধিতা থেকে বিরত থাকেনি বরং প্রকাশ্যে তাঁকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। অথচ তাদের অধিকাংশই তাঁর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনেনি। কুরাইশের অন্যান্য পরিবারের লোকেরাও রাসূলুল্লাহর (সা.) রক্ত সম্পর্কের আত্মীয় - স্বজনদের এ সমর্থন - সহযোগিতাকে আরবের নৈতিক ঐতিহ্যের যথার্থ অনুসারী মনে করতো। তাই তারা কখনো বনী হাশেম ও বনী মুত্তালিবকে এই বলে ধিক্কার দেয়নি যে, তোমরা একটি ভিন্ন ধর্মের আহবায়কের প্রতি সমর্থন দিয়ে নিজেদের পৈতৃক ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয়ে গেছো। তারা একথা জানতো এবং স্বীকারও করতো যে, নিজেদের পরিবারের একজন সদ্যস্যকে তারা কোনক্রমেই শক্রর হাতে তুলে দিতে পারে না। কুরাইশ তথা সমগ্র আরবের অধিবাসীরাই নিজেদের আত্মীয়ের সঙ্গে সহযোগিতা করাকে একটি সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বিষয় বলে মনে করতো ।

জাহেলী যুগেও আরবের লোকেরা এ নৈতিক আদর্শকে অত্যন্ত মর্যাদার চোখে দেখতো। অথচ শুধু মাত্র একজন লোক ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ ও শত্রুতায় অন্ধ হয়ে এ আদর্শ ও মূলনীতি লঙ্ঘন করে। সে ছিল আবু লাহাব ইবনে আবদুল মুত্তালিব। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চাচা। রাসূলের (সা.) পিতা এবং এ আবু লাহাব ছিল এই পিতার সন্তান। আরবে চাচাকে বাপের মতই মনে করা হতো। বিশেষ করে যখন ভাতিজার বাপের ইন্তিকাল হয়ে গিয়েছিল তখন আরবীয় সমাজের রীতি অনুযায়ী চাচার কাছে আশা করা হয়েছিল, সে ভাতিজাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসবে। কিন্তু এ ব্যক্তি ইসলাম বৈরিতা ও কুফরী প্রেমে আকণ্ঠ ডুবে গিয়ে এ সমস্ত আরবীয় ঐতিহ্যকে পদদলিত করেছিল।

মুহাদ্দিসরা বিভিন্ন সূত্রে ইবনে আব্বাস থেকে একটি হাদিস উদ্ধৃত করেছেন। তাতে বলা হয়েছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বসাধারণের কাছে দাওয়াত পেশ করার হুকুম দেয়া হলো এবং কোরআন মজিদে এ মর্মে নির্দেশ দেয়া হলো, ‘সবার আগে আপনার নিকট আত্মীয়দেরকে আল্লাহর আজাবের ভয় দেখান।’ এ নির্দেশ পাওয়ার পর সকাল বেলা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাফা পাহাড়ে উঠে বুলন্দ আওয়াজে চিৎকার করে বললেন, (হায়, সকাল বেলার বিপদ!) আরবে এ ধরনের আওয়াজ এমন এক ব্যক্তি দিয়ে থাকে যে ভোর বেলার আলো আঁধারীর মধ্যে কোনো শত্রুদলকে নিজেদের গোত্রের ওপর আক্রমণ করার জন্য এগিয়ে আসতে দেখে থাকে। রাসূলুল্লাহর (সা.) এ আওয়াজ শুনে লোকেরা জিজ্ঞেস করলো, কে আওয়াজ দিচ্ছে? বলা হলো মুহা‌ম্মাদ (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আওয়াজ দিচ্ছেন। একথা শুনে কুরাইশদের সমস্ত পরিবারের লোকেরা দৌড়ে গেলো তাঁর দিকে। যে নিজে আসতে পারতো সে নিজে এসে গেলো এবং সে নিজে আসতে পারতো না সে তার একজন প্রতিনিধি পাঠিয়ে দিল। সবাই পৌঁছে গেলে তিনি কুরাইশের প্রত্যেকটি পরিবারের নাম নিয়ে ডেকে ডেকে বললেন, হে বনী হাশেম! হে বনী আবদুল মুত্তালিব! হে বনী ফেহর! হে বনী উমুক! হে বনী উমুক! যদি আমি তোমাদের এ কথা বলি, এ পাহাড়ের পেছনে একটি সেনাবাহিনী প্রস্তুত হয়ে রয়েছে তোমাদের ওপর আক্রমণ করার জন্য, তাহলে আমার কথা কি তোমরা সত্য বলে মেনে নেবে? লোকেরা জবাব দিল, হ্যাঁ, আমরা কখনো আপনার মুখে মিথ্যা কথা শুনিনি। একথা শুনে তিনি বললেন, তাহলে আমি তোমাদের সতর্ক করে দিচ্ছি, আগামীতে কঠিন আযজাব আসছে। একথায় অন্যকেউ বলার আগে তাঁর নিজের চাচা আবু লাহাব বললো, ‘তোমার সর্বনাশ হোক, তুমি কি এ জন্য আমাদের ডেকেছিলে?’ অন্য একটি হাদিসে একথাও বলা হয়েছে, সে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে ছুঁড়ে মারার জন্য একটি পাথর উঠিয়েছিল। (মুসনাদে আহমাদ, বুখারী , মুসলিম, তিরমিযী, ইবনে জারীর ইত্যাদি)।

ইবনে যায়েদ বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে, আবু লাহাব একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলো, যদি আমি তোমার দ্বীন গ্রহণ করি তাহলে এর বদলে আমি কি পাবো? তিনি জবাব দিলেন, অন্যান্য ঈমানদাররা যা পাবে আপনিও তাই পাবেন। আবু লাহাব বললো, আমার জন্য কিছু বাড়তি মর্যাদা নেই? জবাব দিলেন, আপনি আর কি চান? একথায় সে বললো, ‘সর্বনাশ হোক এ দ্বীনের যেখানে আমি ও অন্যান্য লোকেরা একই পর্যায়ভুক্ত হবে।’(ইবনে জারীর)।

চলবে...