• সোমবার ২৯ এপ্রিল ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ১৬ ১৪৩১

  • || ১৯ শাওয়াল ১৪৪৫

দোড় গোড়ায় মাহে রমজান, প্রস্তুতি কতটুকু?

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২৩ এপ্রিল ২০২০  

কল্যাণের মাস- পবিত্র রমজানুল মোবারক। আল্লাহ মহান কর্তৃক ঘোষিত মাগফেরাতের বারিধারায় সিক্ত হয়ে দূরীভূত হয় সব পাপ-পঙ্কিলতা। ঈমান জাগানিয়া মাস- পবিত্র রমজান। ধ্যানমগ্ন ইবাদতের উর্বর মৌসুম। নিজেকে বদলানোর মাস রমজানুল মোবারক।

কিন্তু এ মহিমাম্বিত মাসে আমরা কতটুকু বদলাতে পারি নিজেকে? রমজানের আগমনে কতটুকু বদলায় আমদের সমাজ ব্যবস্থা? এবারও কতটুকু বদলাতে পারব? জীবন বদলানোর ঐশী হাওয়া এবারের রমজানে লাগবে কি আমাদের জীবনে?

রমজানুল মোবারকের স্নিগ্ধ বারিধারায় সিক্ত হতে প্রস্তুতি প্রয়োজন। আগাম প্রস্তুতি। পূর্ব প্রস্তুতি। প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের উচিত রমজান মাস আসার আগ থেকেই এ প্রস্তুতি গ্রহণ করা। রমজানের জন্য এমনভাবে কর্মসূচি সাজানো উচিত; যাতে  ইবাদতের জন্য অধিক সময় বরাদ্দ করা সম্ভব হয় এবং গোটা রমজান মাসটি কাটানো সম্ভব হয় কল্যাণকামিতায়।

রাসূল (সা.) অনেক আগে থেকেই (আরবি রজব ও শাবান থেকে) রমজানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা শুরু করতেন। সাহাবায়ে কেরামকেও রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণের তাগিদ দিতেন। রজব মাস থেকেই রমজান প্রাপ্তির দোয়া করা শুরু করতেন তিনি। রাসূল (সা.) রজব ও শাবান মাসব্যাপী এ দোয়াটি বেশি বেশি পড়তেন- 

‘আল্লাহুম্মা বারিক লানা ফি রজাবা ওয়া শাবান ওয়া বাল্লিগনা রমাদান’। ‘হে আল্লাহ! রজব ও শাবান মাসকে আমাদের জন্য বরকতময় করুন এবং রমজান আমাদের নসিব করুন।’ (বুখারি)।

হজরত আয়েশা সিদ্দিকা (রা.) বলেন, ‘রাসুলের আমলের আধিক্য দেখে আমরা বুঝতে পারতার যে রজব মাস উপিস্থত।’

হজরত উম্মে সালমা (রা.) বলেন, ‘রমজান মাস ছাড়া নবী করিম (সা.) সবচেয়ে বেশি রোজা পালন করতেন শাবান মাসে, এরপর সবচেয়ে বেশি রজব মাসে।’ কোনো কোনো বর্ণনায় পাওয়া যায়, রাসূল (সা.) রজব মাসে ১০টি রোজা রাখতেন, শাবান মাসে ২০টি রোজা রাখতেন এবং রমজান মাসে ৩০টি বা চাঁদ দেখা সাপেক্ষ্যে ২৯টি রোজা রাখতেন। (দারিমি)।

হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘রজব হলো আল্লাহর মাস। শাবান হলো আমার (রাসূলের) মাস। আর রমজান হলো আমার উম্মতের মাস।’ (তিরমিজি)।

অন্য হাদিসে এসেছে, রাসূলে আকরাম (সা.) বলেন, ‘যারা রজব মাসে জমি চাষ দেবে না, শাবান মাসে বীজ বপন করবে না, তারা রমজান মাসে ফল লাভ করতে পারবে না।’

এভাবে রজব মাস থেকেই রাসূল (সা.) রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণার্থে দোয়া করতেন এবং রোজা রাখতেন। তিনি নিজে দোয়া করতেন ও রোজা রাখতেন এবং পরিবারবর্গসহ সাহাবিদের দোয়া করা ও রোজা রাখার ব্যাপারে উৎসাহিত করতেন। এছাড়া রজব মাসে লাইলাতুল মিরাজ ও শাবান মাসে লাইলাতুন নিসফ মিন শাবানকে কেন্দ্র করে রাসূল (সা.) রমজানের জন্য নিজেকে চূড়ান্তভাবে প্রস্তুত করতেন। সুতরাং হাদিসে রাসূলের (সা.) বর্ণনার আলোকে একথা বলা যায় যে, আরবি রজব ও শাবান মাসই হলো রমজানের প্রস্তুতি গ্রহণের মাস।

রমজান মাসে যেহেতু অন্যান্য মাসের তুলনায় ইবাদতের আয়োজন বেশি থাকে এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনের বিভিন্ন আমলি আয়োজন সংযুক্ত হয়- সেজন্য এ মাসে স্বাভাবিকভাবে সময়সূচিতে পরিবর্তন আসে। আর নতুন সময়সূচি ও নতুন অতিরিক্ত আমলের সঙ্গে নিজেকে অভ্যস্ত করে তোলার জন্য পূর্ব প্রস্তুতির কোনো বিকল্প নেই।

জীবনের প্রতিটি কাজের জন্য আমরা প্রস্তুতি গ্রহণ করি এবং এই প্রাক প্রস্তুতি গ্রহণের কারণে কাজের সফলতা শতভাগ নিশ্চত হয়। প্রতিটি ইবাদতের সওয়াব বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়ার পাশাপাশি মুমিনের জীবন বদলে দেয়ার যে মহাসুযোগ রমজান নিয়ে আসে, তা যেন কিছুতেই হাতছাড়া না হয় সেজন্য প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের রমজান পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন। প্রতিটি মুসলমানের উচিত নিজেদের আল্লাহর কাছে নিবেদন করতে রমজানের আগেই যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা। রমজানের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে নিম্নের বিষয়গুলো খেয়াল রাখা যেতে পারে-

জ্ঞানার্জনের প্রস্তুতি : জ্ঞান শিক্ষা করা প্রত্যেক মুসলিম নর-নারীর ইসলামি বিধান মোতাবেক ফরজ বা আবশ্যক। প্রত্যেক মুসলমানের উচিত পবিত্র রমজান মাসের প্রয়োজনীয় বিভিন্ন মাসআলা-মাসায়েল আগ থেইে জেনে নেয়া। রমজান মাস কোরআন নাজিলের মাস সুতরাং এ মাসে প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের উচিত পবিত্র কোরআনের জ্ঞান অর্জনে নিজেকে নিয়োজিত রাখা। যারা কোরআন সহিহভাবে তিলাওয়াত করতে পারেন না, তারা তিলাওয়াত শিখতে পারেন এবং যারা কোরআনের তিলাওয়াত পারেন, তারা কোরআনের অর্থ ও ব্যাখ্যা পড়ায় সময় কাটাতে পারেন। এছাড়া ইসলামী জ্ঞান অর্জনে সময় কাটানোর জন্য রমজানের আগ থেকেই বই নির্বাচন করে রাখতে পারেন এবং সময় ঠিক করে রাখতে পারেন- কখন কোন বইটি পড়বেন।

ব্যক্তিগত প্রস্তুতি : প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের উচিত রমজান মাসটি তিনি কীভাবে কাটাবেন তার একটি পরিকল্পনা করা। দিনের কোন সময় কী কাজ করবেন এবং রাত কীভাবে কাটাবেন- সব কাজের বিস্তারিত তালিকা ও সময়সূচি তৈরি করা। এছাড়া সাংসারিক কাজ বা দায়িত্ব আঞ্জাম দেয়া, চাকরি বা ব্যবসায় সময় দেয়াসহ কখন কোনো ইবাদত বা আমল করবেন তারও একটি সময়সূচি তৈরি করে নিলে ভালোভাবে রমজান কাটানো সম্ভব হবে।

পরিবারিক প্রস্তুতি : রমজান মাসে মুসলিম পরিবারে বেশ কিছু বাড়তি আমল-আয়োজন সংযুক্ত হয়। সেমতে প্রত্যেকটি মুসলিম পরিবারে সফলভাবে রমজান যাপনের জন্য পূর্ব প্রস্তুতি গ্রহণ আবশ্যক। পরিবারের সদস্যদের রমজানের প্রতি আগ্রহী করে তুলতে রোজার ফজিলতের হাদিস ও এর বিভিন্ন উপকারিতা তুলে ধরে খাবারের টেবিলে বা অন্য কোনো সুযোগে প্রতিদিন কিছু সময় ঘরোয়া তালিম হতে পারে। সবাই মিলে গোটা রমজানের একটি পারিবারিক রুটিন তৈরি করে নেয়া উচিত। এতে রমজানের পূর্ণ হক আদায় করা সহজ হবে।

সামাজিক প্রস্তুতি : ইসলাম মানুষের ব্যক্তি জীবনের পাশাপাশি মানুষের পারিবারিক ও সামজিক জীবনকেও গুরুত্ব দিয়েছে। পবিত্র রমজান মাসে কোনোভাবেই যেন সমাজ কলুষিত না থাকে; সেমতে মুসলিমদের প্রস্তুতি গ্রহণের পাশাপাশি সমাজের পরিচালক-অভিভাবকদের উচিত প্রস্তুতি গ্রহণ করা। রমজানের পবিত্রতা রক্ষায় এ মাস আসার আগেই সামাজিকভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে, যেন সমাজটাও হয় ইসলামবান্ধব। এছাড়া সামাজিক পরিমনণ্ডলে রমজানের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে প্রতিবেশী ও সমাজের লোকজন একে অন্যের সঙ্গে দেখা হলে রমজানের বিভিন্ন ফজিলত ও ইতিবাচক দিক নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। এসব আলোচনার দ্বারা অনেকে রোজার বিষয়ে উদ্বুদ্ধ হবেন এবং অনেকে রোজাদারদের সম্মান প্রদানে সচেষ্ট হবেন।

গৃহিণীর প্রস্তুতি : রমজান মাসে পরিবারে সংযুক্ত বিশেষ আমল সেহরি ও ইফতার ব্যবস্থাপনায় নারীদের ভূমিকা মূখ্য। মা-বোন বা স্ত্রী-গৃহিণীরা রমজান আসার আগেই এ জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে পারেন এবং কিছু কাজ এগিয়ে রাখতে পারেন। অবশ্যই মনে রাখতে হবে- এগুলোতে লিপ্ত থেকে যেন নিজের ইবাদতে ব্যাঘাত না ঘটে। কিছুতেই যেন ফরজ নামাজ, তারাবি ছুটে না যায়- সে দিকে খেয়াল রাখা। প্রত্যেক গৃহিণীর আরো একটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখা উচিত- কোনোভাবেই যেন এই মাসে কোনো অপব্যয় ও অপচয় না হয়।
 
শিক্ষার্থীদের প্রস্তুতি : রমজানে স্কুলগুলো সাধারণত বন্ধ থাকে। তাই এ সময় অভিভাবকদণ সন্তানদের কোরআন শিখানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। এছাড়া অন্যান্য শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন কোর্স বা প্রশিক্ষণ গ্রহণে সময় ব্যয় করতে পারেন।  

চাকরিজীবীদের প্রস্তুতি : পবিত্র রমজান মাস একটি ট্রেনিং কোর্স। চাকরিতে মালিককে না ঠকানো এবং ইবাদত ছেড়ে নিজেকে না ঠকানোই হোক প্রত্যেক চাকরিজীবীর এবারের রমজানের সংকল্প। এছাড়া পবিত্র রমজান মাসের পবিত্রতা রক্ষার্থে সব ধরনের অনৈতিক অভ্যাস ত্যাগ করা উচিত। অফিসের কাজের ফাঁকে ও যাতায়েতের সময় নিজেকে বিভিন্ন ইবাদতে মশগুল রাখা। মোবাইলে কোরআন শরিফসহ বিভিন্ন ইসলামিক অ্যাপস চালু করে তা কাজে লাগানো যেতে পারে।

ব্যবসায়ীদের প্রস্তুতি : রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি চল্লিশ দিন খাদ্য মজুদ রাখল; সে আল্লাহর কাছ থেকে নিঃসম্পর্ক হয়ে গেল এবং আল্লাহ নিঃসম্পর্ক হয়ে গেলেন তার থেকে।’ (মুসনাদে আহমাদ : ৮/৪৮১)। রমজান এলেই এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা দ্বিগুণ লাভের আশায় পণ্য মজুদ করে রাখে- এটা কোনোভাবেই ইসলাম সমর্থন করে না। পণ্য মজুদকরণ বা অপকৌশলে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে ‘বড়লোক’ হওয়ার স্বপ্নে বিভোর থাকা কোনো মুসলিম ব্যবসায়ী আদর্শ হতে পারে না। সুতরাং ব্যবসায়ী ভাইদের উচিত রমজান উপলক্ষে কীভাবে পণ্যের মূল্য কমিয়ে রোজাদারদের সহযোগিতা করার মাধ্যমে সাওয়াব অর্জন করা যায় সেমতে প্রস্তুতি গ্রহণ করা।

মোটকথা- রমজান হলো আমল-ইবাদাতের মাস। দোয়া কবুল ও তাওবার মাস। সুতরাং এ মসটিকে যেন যথাযথভাবে আমল-ইবাদত ও কল্যাণকামিতায় ব্যয় করা যায় সেমতে প্রত্যেক মুমিন-মুসলমানের প্রস্তুতি গ্রহণ করা আবশ্যক।