• মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৪ ১৪৩১

  • || ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫

আধ্যাত্মিক ক্ষমতার নামে অপচিকিৎসা

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২১ মে ২০১৯  

পক্ষাঘাত (প্যারালিসিস), বাক্প্রতিবন্ধী, মানসিক প্রতিবন্ধীসহ সব ধরনের রোগের ‘চিকিৎসা’ করেন তিনি রোগীকে সুস্থ করে দেওয়ার চ্যালেঞ্জ করেন সন্তানহীন নারীকে সন্তান পাইয়ে দেওয়ার নিশ্চয়তা দেন পানিপড়া, তেলপড়া, বিশেষ ধরনের মলম আর রোগীর কানে কানে কিছু একটা বলে চলছে তার ‘চিকিৎসা’ অথচ এই ‘সর্ব রোগের চিকিৎসকই’ কি না তার স্ত্রীর চিকিৎসা করিয়েছেন হাসপাতালে তিনি হলেন আধ্যাত্মিক ক্ষমতার দাবিদার বেলাল পাগলা

হাজার হাজার মানুষ বিশ্বাস করে বেলাল পাগলার কাছে আসছে ‘চিকিৎসা’ নিতে তিনি হাতিয়ে নিচ্ছেন টাকা স্বাস্থ্য বিভাগের দায়িত্বশীলরা বলছেন, এটা অপচিকিৎসা, প্রতারণা

বেলাল পাগলার বাড়ি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার হরগজ গ্রামে নিজ বাড়িতে বড় এলাকাজুড়ে গড়ে তুলেছেন ‘বেলাল পাগলার দরবার শরিফ’ সবাই বলে বেলাল পাগলার আস্তানা এখানে নারী ও পুরুষদের জন্য রয়েছে পৃথক হলঘর প্রতি শুক্রবার তিনি রোগী দেখেন এদিন কমপক্ষে এক হাজার রোগী এবং তাদের সঙ্গে তিন-চার হাজার লোক আসে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাস, মিনিবাস, প্রাইভেট কার, স্কুটারে করে আসে রোগীরা তাদের ঘিরে আস্তানায় গড়ে উঠেছে অন্তত ২০টি দোকান দোকানগুলো থেকে কিনে নিতে হয় পানি ও তেলের বোতল আর মলম বেলাল মূলত এই পানি ও তেল পড়ে দেন রোগীদের বোতল বাবদ নেওয়া হয় ৩০ টাকা বিশেষভাবে তৈরি প্রতি কৌটা মলমের দাম ১০০ টাকা মলম বিক্রি করে বেলালের লোকজন

বেলাল পাগলার ছেলে মোহাম্মদ বাবু জানান, তার বাবা একসময় বিআইডাব্লিউটিএতে (বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ) গ্রিজম্যান হিসেবে চাকরি করতেন ২০০৬ সালে তিনি অবসরে যান এর অনেক আগেই বেলাল পাগলা ‘আধ্যাত্মিক ক্ষমতার অধিকারী হন’ তখন থেকেই তিনি মানুষজনকে চিকিৎসা দিয়ে আসছেন তবে অবসরে যাওয়ার পর তিনি আস্তানাটি গড়েন

 

কয়েকজন এলাকাবাসী জানায়, দিনে দিনে বেলাল পাগলার আস্তানা বড় হয়ে উঠছে তিনি মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে ব্যবসা করছেন তেল, পানি আর মলম বিক্রি করেই প্রতি শুক্রবার মোটা অঙ্কের টাকা কামান এ ছাড়া আছে ভক্তদের মোটা অঙ্কের হাদিয়া দেশজুড়ে একটি নেটওয়ার্ক আছে তাঁর বিশেষ করে নোয়াখালী, কুমিল্লা, বরিশাল, ময়মনসিংহসহ উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় এজেন্ট রয়েছে তারাই কমিশনের ভিত্তিতে রোগী ম্যানেজ করে

ছয় মাস আগে স্ট্রোক হওয়ার পর বাঁ হাত ও পা অবশ হয়ে যায় আব্দুল্লা রাহির সম্প্রতি ঢাকা থেকে কলেজছাত্রী মেয়ে কানিজ ফাতেমাকে নিয়ে তিনি আসেন বেলাল পাগলার আস্তানায় ফাতেমা বলেন, ঢাকায় তার বাবার চিকিৎসা হচ্ছে আগের চেয়ে তিনি অনেক সুস্থ কিন্তু বাবার তর সইছে না লোকমুখে শুনে এসেছেন বাবা তবে ফাতেমার বিশ্বাস নেই এ চিকিৎসায় শুধু বাবার মনের শান্তির জন্য এসেছেন

ছেলে মাহিনকে (৭) নিয়ে তৃতীয়বার আসা মা শাহিনা বেগম বলেন, ছেলে খুব চঞ্চল, পাগলামি করে বেলাল পাগলা প্রতিবারই পানি ও তেল পড়া এবং মলম দিয়েছেন এ পর্যন্ত তিনি ৯০০ টাকায় ৯ কৌটা মলম কিনেছেন তবে ছেলের উন্নতি হয়নি

ভ্যানচালক জহিরের ছেলে আজাদের ১০ বছর বয়সে হঠাৎ পা অবশ হয়ে যায় ঠিকভাবে হাঁটতে পারে না ডাক্তার দেখিয়েও কাজ হয়নি জহির জানান, লোকমুখে বেলাল পাগলার কথা শুনে দশ-বারো জনের সঙ্গে তিনি গাইবান্ধা থেকে এসেছেন এ নিয়ে চারবার ১৪ কৌটা মলমের সঙ্গে পানি ও তেল কিনতে হয়েছে তবে ছেলের কোনো উন্নতি দেখছেন না

আগামী বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে শুভ ছয় মাস আগে থেকে হঠাৎ ডান চোখে দেখতে পায় না ঢাকায় ইসলামিয়া হাসপাতালে দেখানোর পর চিকিৎকরা জানান, অন্তত সাতটি ইনজেকশন দিতে হবে প্রতিটির দাম ৩৫ হাজার টাকা আর ডান চোখের জন্য মাইনাস ১৩.২৪ পাওয়ারের চমশা দেন শুভর বাবা হামিদুর রহমান আলী ভারতে চিকিৎসা করার সিদ্ধান্ত নেন এর মধ্যে এক আত্মীয় বেলাল পাগলার কথা জানান (বেলালের দরবারেই থাকেন) এর আগে দুবার ছেলেকে নিয়ে দরবারে এনেছেন তিনি বলেন, বেলাল পাগলা কানে কানে কিছু একটা বলেছে শুভকে কিন্তু তা কাউকে জানানো যাবে না কেবল শুভই জানবে এভাবেই চিকিৎসা চলছে তবে ছেলের অবস্থা আগের মতোই

 

সম্প্রতি এ প্রতিবেদক আস্তানাটিতে গিয়ে মোবাইল ফোনে বেলাল কোথায় আছেন জানতে চাইলে বেলাল বলেন, ‘আমার স্ত্রী অসুস্থ তাকে নিয়ে হাসপাতালে এসেছি আপনি শুক্রবার আসবেন দেখা হবে’ এরপর ফোনের সংযোগ কেটে দেন বেলাল

বেলাল পাগলার ছেলে মোহাম্মদ বাবু বলে, ‘আমার মায়ের মেরুদণ্ডের হাড় ক্ষয় হয়েছে তাই ডাক্তার দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল

বেলাল দাবি করেন, তিনি কোনো রোগীর কাছ থেকে টাকা নেন না বিশ্বাসই তার শক্তি তিনি বলেন, ‘মানবসেবাই পরম ধর্ম আমাকে নিয়ে অনেকে অনেক কথা বলে কিন্তু আমাকে কেউ এই ধর্ম পালন থেকে পিছু হটাতে পারেনি

মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সদর হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার  (আরএমও) ডা. মো. লুত্ফর রহমান বলেন, বৈজ্ঞানিকভাবে ঝাড়-ফুঁক দিয়ে চিকিৎসার কোনো ভিত্তি নেই এসব ভুয়া, অপচিকিৎসায় রোগীর বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারে এসব যারা করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত সাধারণ মানুষকে এসব লোকের কাছে না গিয়ে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি