• বৃহস্পতিবার ০৯ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৬ ১৪৩১

  • || ২৯ শাওয়াল ১৪৪৫

বাঙালির পহেলা বৈশাখ বরণের আদ্যোপান্ত

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১৩ এপ্রিল ২০১৯  

উৎসবপ্রেমী জাতি হিসেবে বাঙালির খ্যাতি বিশ্বজোড়া। বারো মাসে তেরো পার্বণের রীতি মূলত শুরু হয় বছরের প্রথম দিনটি আড়ম্বরের সাথে উদযাপনের মধ্য দিয়ে। শুধু বাংলা কেন; নতুন বছরের প্রথম দিনটি উদযাপনের রীতি পালিত হয়ে আসছে পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে, নিজস্ব রঙে, নিজস্ব ঢঙে। কোনো কোনো জাতির কাছে নববর্ষ উদযাপনের তাৎপর্য ধর্মীয়, আবার কোনো জাতির কাছে নববর্ষ ধরা দিয়েছে ঊষর শীতের রিক্ততা পেছনে ফেলে উর্বর বসন্তের আগমনী বার্তা হিসেবে। 

বাঙালির নববর্ষের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এদেশের মানুষ শান্তিপ্রিয়, সব ধর্মের মোটামুটি সহাবস্থান আমাদের এই বাংলায় বলতে গেলে সব সময়ই ছিলো। প্রকৃতি মাতা আমাদের দু'হাত ভরে দিয়েছেন তার ঐশ্বর্য। জীবন টিকিয়ে রাখতে তাই আমাদের ভাইকিংসহ অন্যান্য আদিম ইউরোপীয়দের মতো প্রকৃতির সাথে লড়াই করতে  হয়নি। যুদ্ধ করতে হয়নি বলেই সে সাজানোর সুযোগ পেয়েছে। সে কারণেই পহেলা বৈশাখের মতো বর্ণিল উদযাপনের উদাহরণ সারা পৃথিবীতেই হয়তো হাতেগোনা। বাংলা নববর্ষের প্রবক্তা হিসেবে সবাই সম্রাট আকবরকে জানেন। কিন্তু আকবরের আগেও কি বাঙলার মানুষ নতুন বছরকে বরণ করে নিতো না? অবশ্যই নিতো। 

আবহমান বাঙলার ঐশ্বর্য ও উৎকর্ষে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে কৃষিকাজ। বাঙালির আনন্দ, উৎসব-উদ্দীপনা যুগ যুগ ধরে মিশে রয়েছে পাকা ফসলের ঘ্রাণের সঙ্গে। তাই প্রাচীন বাংলাতেও ফসল উৎপাদনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে পালন করা হতো নববর্ষের। শুধু আজকের অবশিষ্ট বাংলা নয়, আসাম, মণিপুর, নেপাল, পাঞ্জাবেও একই দিনে নববর্ষ পালিত হতো। গ্রেগোরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এ দিনটি ছিলো এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি সময়ে। তবে তখন সার্বজনীন নয়; বরং সীমিত আকারে পালিত হতো বাংলা নববর্ষ। এর অনেককাল পরে ভারতবর্ষের কর্তৃত্ব পেলো মুঘলরা। মুঘলরা চিন্তা চেতনায় ছিলেন খাস মুসলিম। তাই তারা হিজরি সন অনুযায়ীই দিন তারিখের হিসাব রাখতেন। কিন্তু এ  প্রক্রিয়ায় বিপদে পড়লেন বাংলার সাধারণ চাষীরা, হিজরি দিনপঞ্জী অনুযায়ী বছরের শেষ দিন সব খাজনা ও বকেয়া পরিশোধ করার সময়, কিন্তু তখনই কি না মাঠে ফসল নেই! 

এই মহা দুর্বিপাকের হাত থেকে বাঙালিদের রক্ষা করেন সম্রাট আকবর। সিংহাসনে বসেই তিনি তখনকার সময়ের বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহউল্লাহ সিরাজীকে আদেশ দিলেন বাংলা সৃনের সঠিক দিনপঞ্জী প্রণয়নের। ফতেহউল্লাহ সিরাজী সৌর সন এবং হিজরী সনের সমন্বয়ে বাংলা সনকে পুনরিজ্জীবিত করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ থেকে সর্বপ্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। প্রথমে কৃষক ও মহাজনদের মধ্যে বাংলা নববর্ষ পালন শুরু হলেও ক্রমেই তা ছড়িয়ে যায় আপামর বাঙালির মাঝে। সত্তরের দশক থেকে পহেলা বৈশাখ পালন অনেক জনপ্রিয় হতে থাকে। 

নববর্ষে শুধু যে কৃষকরাই নতুন স্বপ্ন দেখে তা নয়, ব্যবসায়ীরা নতুন হিসেবের খাতা খোলেন, তারাও আশা করেন চৈত্র মাসের শেষ দিনটাতে যেন পুরনো সব দেনা-পাওনা চুকে দিয়ে নতুন বছরটাতে নতুন করে সব শুরু করা যায়। এরকম ভাবনা থেকেই মূলত হালখাতা উৎসবের আয়োজন। এদিন সাধারণ আটপৌরে বাঙালিটিও নতুন রঙিন পোশাকে নিজেকে সাজিয়ে নতুন করে জীবন গড়ার স্বপ্ন দেখে- নববর্ষের সবচেয়ে বড় সার্থকতা এখানেই। অনেকেই অভিযোগ করেন কালের আবহে, ইট কাঠের এই নেক্রোপলিসে পহেলা বৈশাখের আয়োজনগুলো সব ফিঁকে হয়ে আসছে। তবে নববর্ষের উদযাপনের তালিকায় মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো আধুনিক যুগের বহু সংযোজন দেখে মনে হয় - বৈশাখে বাঙালি সাজবেই, বৈশাখে বাঙালি নতুন করে স্বপ্ন দেখবেই!