• মঙ্গলবার ০৭ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৪ ১৪৩১

  • || ২৭ শাওয়াল ১৪৪৫

পাচার নয়, উচ্ছল শৈশব

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ৩ ডিসেম্বর ২০১৮  

বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও নারী ও শিশু পাচারের বিষয়টি মূলত রয়ে গেছে পর্দার অন্তরালে এবং আলোচনার বাইরে। যদিও মেধা পাচার থেকে শুরু করে নারী ও শিশু পাচার এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। নারী ও শিশু পাচার শুধু আইন-শৃঙ্খলার অবনতির বিশেষ সূচকই নয়, তা নারী ও শিশুর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও মানবাধিকার নিশ্চিতকরণ সংক্রান্ত সাংবিধানিক নিশ্চয়তা এবং সিআর-সিডও বাস্তবায়নে আন্তর্জাতিক দায়িত্বের অংশবিশেষও বটে।

নারী ও শিশু পাচারের সঙ্গে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ নারী ও শিশু পাচারকারীরা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার নিমিত্তে এ জঘন্য কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়। তবে আইওএম অর্থাৎ ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর মাইগ্রেশনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী মানব পাচার তখনই ঘটে, যখন একজন অভিবাসী জাতীয় অথবা আন্তর্জাতিক সীমান্ত অতিক্রম করে অবৈধভাবে (চাকরি প্রাপ্তির আশায় অপহৃত হয়ে বিক্রি হয়) কোনো কাজে নিযুক্ত হয়। বাংলাদেশ থেকেও প্রতি বছর একটা বড় সংখ্যক নারী ও শিশু পাচার হয়ে থাকে।

নারী ও শিশু পাচারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কারণ হলো, পরিবারে নারীর অধস্তন অবস্থান, যা সমাজে প্রচলিত বিভিন্ন মূল্যবোধ, আচার-আচরণ ও সামাজিক রীতি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত। আমাদের সমাজে নারীর সামাজিক অবস্থান তার বৈবাহিক অবস্থা দ্বারা নির্ধারিত। বিশেষ করে দরিদ্র পরিবারের পিতা-মাতারা মেয়েদের জন্য আইন দ্বারা নির্ধারিত বিয়ের উপযুক্ত বয়স ১৮ বছরের কম হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে দেওয়াটা দায়িত্ব বলে মনে করে, যার দুটি খারাপ পরিণতি রয়েছে। যেসব ছেলে বিয়েতে যৌতুক চায় না, কন্যাদায়গ্রস্ত দরিদ্র পিতা-মাতারা তাদের সঙ্গে খোঁজখবর ছাড়াই কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তা করে। অনেক পাচারকারী এই দুর্বলতার সুযোগ নেয়। তারা অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে করে নিয়ে গিয়ে বিদেশে পাচার করে দেয়। দ্বিতীয় পরিণতি হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রে সহায়সম্বলহীন পিতা-মাতা বিয়ের সময় যৌতুকের দাবি মেনে নিয়ে বিয়ের ব্যবস্থা করে পর আর শোধ করতে পারে না। তখন মেয়েটি তার স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের নির্মম নির্যাতনের শিকারে পরিণত হয়। একদিকে মেয়েটি বাবার বাড়িতেও ফিরে যেতে পারে না, অন্যদিকে নির্যাতনের নির্মমতা সহ্যের মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। এ রকম অসহায় অবস্থার সুযোগ নেয় পাচারকারী চক্র। বিয়ের পর স্ত্রী রেখে পালিয়ে যাওয়া এবং বৈবাহিক সন্ত্রাস পাচারের কারণ হিসেবে কাজ করে। যুবতী, অবিবাহিত অথবা স্বামী পরিত্যক্ত এবং বিধবা নারী সমাজ ও পরিবারের কাছে বোঝাস্বরূপ। এই শ্রেণির নারীর কাছে বিকল্প কর্ম অথবা বিয়ের প্রস্তাব আকর্ষণীয় বলে মনে হয়। তারা পাচারকারী চক্রের সদস্যদের বিয়ে বা লোভনীয় চাকরির প্রস্তাবে সহজেই সাড়া দেয় আর শেষ পর্যন্ত পাচারকারীদের পাতা জালে আটকা পড়ে। তারপরও বাংলাদেশের খুলনা অঞ্চলের শিশুশ্রম পাচারের ঝুঁকি এবং শোষণ কমানো, শিশু পাচার, নির্যাতন ও শোষণ প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম বৃদ্ধি করা, শিশু ও নারী পাচার প্রতিরোধে সব পর্যায়ের সহযোগী সংগঠন ও ব্যক্তির সঙ্গে নেটওয়ার্কিং ও সমন্বয় বৃদ্ধি, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সমমনা ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পাচারকৃতদের উদ্ধার, তাদের পরিবারে ও সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং পুনর্বাসন করা, পাচার ও শোষণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ শিশুদের রক্ষাকল্পে দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষিত পরিবেশ তৈরি করার উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে বেসরকারি সংগঠন ‘ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ’। চাইল্ড সেফটি নেট প্রজেক্ট নামে কার্যক্রম চালাচ্ছে ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ। খুলনার বয়রা ও যশোরে এর কার্যালয় রয়েছে।

অধিক জনসংখ্যা, দারিদ্র্য, শিক্ষার অভাব, অসচেতনতা, দ্রুত নগরায়ন, অভিবাসন, যৌন ব্যবসার দ্রুত প্রসার, অধিক মাত্রায় ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ইত্যাদি এশিয়াকে শিশু ও নারী পাচারের জন্য পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত করেছে। বাংলাদেশ এর মধ্যে অন্যতম। প্রতি বছর হাজার হাজার শিশু ও নারী দেশের মধ্যে ও বাইরে পাচারের শিকার হচ্ছে। তারা ভারত ও অন্য দেশে পাচার হয় এবং এদের মধ্যে অনেককে বাধ্যতামূলক যৌনকাজ, ভিক্ষাবৃত্তি, চোরাচালান, অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিক্রি, কলকারখানায় ঝুঁকিপূর্ণ শ্রম, পর্নোগ্রাফি, রক্ষিতা, বাধ্যতামূলক শ্রম ইত্যাদি কাজে ব্যবহার করা হয়।

শিশু পাচারের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পরিবার এবং শিশু। প্রকল্প যাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করবে- আইন প্রয়োগকারী কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি এবং সমাজভিত্তিক সংস্থা, স্কুলশিক্ষক ও কমিটি, মানবাধিকার কর্মী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, সামাজিক ও ধর্মীয় নেতারা, সাংবাদিক, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা, স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার।

শিশুদের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতকল্পে তিনটি বিশেষ বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করা হবে। শিশুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত শোষণ, নির্যাতন, বঞ্চনা, পাচার ইত্যাদি বিষয়ে সচেতনমূলক কার্যক্রম গ্রহণ, যেমন- শিশু ও নারী পাচার এবং নির্যাতন প্রতিরোধে জনগণকে সচেতন করা।

শিশু ও নারী পাচার এবং নির্যাতন প্রতিরোধে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সম্পৃক্তকরণ, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের ছাত্রছাত্রীদের সচেতন করা, ঝুঁকিপূর্ণ শিশুর মা-বাবার জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, শিশুবান্ধব প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা, ঝুঁকিপূর্ণ পরিবারগুলোর জন্য দারিদ্র্য বিমোচনের কাজ করা, এলাকাভিত্তিক পাচার প্রতিরোধ কমিটি গঠন ও সক্রিয় করা, শিশু বিকাশের জন্য শিশুবান্ধব কেন্দ্র স্থাপন, শিশু পাচার এবং নির্যাতনের প্রয়োজনীয় সঠিক তথ্য যাতে সংশ্নিষ্ট সবাই পেতে পারে তার জন্য তথ্যকেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা করা।

যেসব শিশু পাচার কিংবা অন্যান্য নির্যাতনের শিকার এবং যারা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তাদের এ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করা এবং বিভিন্ন ধরনের শোষণ ও নির্যাতন বন্ধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করা, যেমন- পাচার থেকে উদ্ধার হওয়া শিশুদের জরুরি সেবাদান, খাদ্য, চিকিৎসা, আশ্রয়সহ অন্য সব সহায়তা প্রদান। সরকারি-বেসরকারি আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করা। পাচার ও নির্যাতনের তথ্যপ্রাপ্তির জন্য হটলাইন স্থাপন ও সক্রিয় রাখা।