• শনিবার ১১ মে ২০২৪ ||

  • বৈশাখ ২৮ ১৪৩১

  • || ০২ জ্বিলকদ ১৪৪৫

পরিবর্তনের সুযোগ পেয়েও ‘কাজে লাগায়নি বিএনপি’

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২২ নভেম্বর ২০১৮  

২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র বিক্ষোভের ঘটনায় কারা নির্যাতিত এই শিক্ষকের মতে, নেতৃত্ব শূন্যতা পূরণে বিএনপি ও তাদের জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী কামাল হোসেনসহ কিছু রাজনীতিককে ‘ভাড়া করে’ নিজেদের দলে ভিড়িয়েছেন।

জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর ১৯৮১ সালে বিএনপির নেতৃত্বে এসে প্রায় চার দশক ধরে দলটি চালাচ্ছেন তার স্ত্রী খালেদা জিয়া। ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার আমলে সরকারি কোনো পদে না থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেন তার ছেলে তারেক রহমান।

বিএনপির সর্বশেষ কাউন্সিলে শীর্ষ পদ চেয়ারপারসন পুননির্বাচিত হন খালেদা জিয়া, তারেক হন জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান। তবে দুর্নীতির মামলায় দণ্ডিত হয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা কারাবন্দি হওয়ার পর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের দায়িত্বে আছেন তারেক রহমান।

মায়ের অনুপস্থিতিতে দলের শীর্ষ পদে এলেও এক দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের বাইরে আছেন তারেক। ২০০৮ সাল থেকে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন তিনি।

এই প্রেক্ষাপটে একাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রার্থী বাছাইয়ে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকারে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে তারেক রহমানকে সম্পৃক্ত রেখেছিলেন বিএনপি নেতারা।

রোববার এভাবেই ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নেন তারেক রহমান

সেই প্রসঙ্গ তুলে ধরে জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক আনোয়ার বলেন, “খালেদা-তারেকের অবর্তমানে বিএনপির জন্য একটা পরিবর্তনের সুযোগ ছিল। কিন্তু যখন তারেক রহমান মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে তখন বোঝা যায়, তাদের মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয়নি।”

একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী দল জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট গড়ে ২০০১ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বিএনপি। এরপরেও তাদের এই সখ্য রয়ে গেছে, যা নিয়ে দলটির সমালোচনা করেন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো।

নির্বাচন সামনে রেখে গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে সক্রিয় রয়েছে বিএনপি।

এ বিষয়ে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, “খালেদা জিয়া ও তারেক জিয়া তাদের অপরাধের জন্য দণ্ডিত হয়ে একজন কারাগারে আছে এবং একজন পলাতক আছে। সেই অবস্থায় বিএনপি-জামায়াত কিন্তু ভাড়া করে নিয়ে এসেছে ড. কামাল হোসেনকে এবং আরো কিছু রাজনীতিককে। এই অবস্থা কিন্তু হয়েছে বাংলাদেশে।”

বৃহস্পতিবার ঢাকায় ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় এসব বলেন আনোয়ার হোসেন। বক্তাদের অনেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে ‘সাম্প্রদায়িক জোট’ আখ্যায়িত করে তাদের ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানান।

কয়েকজন বক্তার অভিযোগ, ওই জোটের নেতারা মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা বলে ‘প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছেন’।

ঐক্যফ্রন্টের দিকে ইঙ্গিত করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “জনগণকে সতর্ক করার প্রয়োজন আছে, কারা আজকে বঙ্গবন্ধুর কথা বলে, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বরোধী শক্তির সাথে মিলিত হয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমাদের প্রতিজ্ঞা হওয়া উচিত সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দেব না। আজকে যারা মুখে বঙ্গবন্ধুর কথা বলে বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন, একই প্রতীকে নির্বাচন করার কথা বলছেন। তাদের উদ্দেশ্য বোঝা যায়।”

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উল্টে দেওয়া হয়েছিল মন্তব্য করে আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “এখনো বিশ্বাসঘাতক রয়ে গেছে। তাদের বোঝা যাবে না। নানা প্রতারণার মাঝ দিয়ে তারা চেষ্টা করছে। সেদিকে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।”

‘আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ও সম্প্রীতির বাংলাদেশ’ শীর্ষক ওই আলোচনায় তিনি বলেন, “২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে এসে যখন আমাদের সম্প্রীতির কথা বলতে হচ্ছে, তখন আমাদের দুঃখ হয়, বেদনা হয়, লজ্জা হয়।

“সাম্প্রদায়িকতাতো আমরা শেষ করে এসেছিলাম ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। যে মুক্তিযুদ্ধে মুসলমানের রক্ত, হিন্দুর রক্ত, বৌদ্ধের রক্ত, খ্রিস্টানের রক্ত, আদিবাসীদের রক্ত এক স্রোতে প্রবাহিত হয়েছে। তারপরে সাম্প্রদায়িকতার জায়গা থাকার কথা না এখানে।”

নির্বাচন ঘিরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা ঠেকাতে ‘ব্রিগেড’ গড়াসহ বিভিন্ন সুপারিশও এসেছে আলোচনা সভা থেকে।

সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, “ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যারা সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে আঁতাত করেছেন তাদের চিহ্নিত করে বর্জন করতে হবে। যারা ঐক্যফ্রন্ট করেছেন এবং যারা নিবন্ধন বাতিলকৃত দলের সঙ্গে গোপনে ঐক্য করছেন, আসন দিচ্ছেন- তাদের মুখে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা যায় না।

“তারা কীভাবে মুখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন?  অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ যারা ধরে রাখতে চান, তাদেরকে এখন ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।”

আগামী নির্বাচন খুব ‘সহজ-সরলভাবে’ হবে না মন্তব্য করে সম্প্রীতি বাংলাদেশের আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “যারা মনে করছেন, এটি বকুল বিছানো পথে হবে, তা কিন্তু হবে না। এবার হবে গোলাপ বিছানো পথে, যে গোলাপের মধ্যে অসংখ্য কাঁটা আছে। যেই কাঁটাগুলোকে দেখা যায় না, কিন্তু হাত দিলে হাতে রক্ত ঝরে। পা ফেললে পায়ে রক্ত ঝরে। আমাদের সাবধানী ও সতর্ক হতে হবে।”

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ‘অসাম্প্রদায়িক শক্তিকে’ ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ এখন আমরা সাফল্যের হাইওয়েতে ছুটছি। আমাদের এই সাফল্যকে ধরে রাখতে হবেই। আসন্ন নির্বাচনে আমাদের সম্মিলিত শক্তিই পারবে, এই সাফল্যকে ধরে রাখতে।”

দেশের ৭০ ভাগ লোক অসাম্প্রদায়িক ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে উল্লেখ করে এই সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব বলেন, “৭০ ভাগ লোক যদি যূথবদ্ধভাবে দাঁড়ায়, প্রতিরোধ গড়ে তোলে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পক্ষে, সংবিধানের পক্ষে, গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করি, তাহলে তো ভয় পাওয়ার কিছু নাই।”

আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে ‘বিএনপি-জামায়াতের কাউকে হত্যা করেনি’ মন্তব্য করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহীম খালেদ বলেন, “২০০৪ সালে শেখ হাসিনার উপরে গ্রেনেড দিয়ে হামলা চালানো হয়েছিল। গ্রেনেড কিন্তু যুদ্ধাস্ত্র। সেই গ্রেনেড ব্যবহার করা হয়েছে এ কারণে যাতে শেখ হাসিনার মৃত্যু ঘটে।”

তিনি বলেন, “খালেদা জিয়ার একটি চুলও ছিঁড়েছেন? বিরোধী দলের কাউকে কিছু করা হয়েছে? এমনকি খুনি মোশতাকেরও স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। কারণ বাঙালি সংস্কৃতিতে যারা বিশ্বাসী তারা সন্ত্রাস করে না। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে বিএনপিও সেইফ। আর বিএনপি ক্ষমতায় আসলে কেবল আওয়ামী লীগ না সংখ্যালঘুসহ সব ধরনের লোক সেইফ থাকবে না।”

একেক আসনে বেশ কয়েকজন মনোনয়নপ্রত্যাশী হওয়ার কথা উল্লেখ করে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, “আওয়ামী লীগ যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, তাহলে তাকে কেউ হারাতে পারবে না। কারণ আওয়ামী লীগকে আওয়ামী লীগ ছাড়া কেউ হারাতে পারবে না। আওয়ামী লীগকে এই সমস্যাগুলোর সমাধান করতে হবে।”

একই সঙ্গে প্রশাসন নির্দলীয় করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “সচিবালয়ে বিএনপির পক্ষের লোক খুব আছে। আশুগঞ্জে প্রশাসন থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, বিজয় মেলা হবে না। ডিসেম্বর মাসে যদি বিজয় মেলা না হতে পারে আওয়ামী লীগের আমলে, তাহলে ভোট দেবে কোথায় গিয়ে?”

নির্বাচন কমিশনের সভায় ঐক্যফ্রন্টের সংগঠক মাহমুদুর রহমান মান্নার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের দিকে ইঙ্গিত করে নারী প্রগতি সংঘের রোকেয়া কবীর বলেন, “আজকে আমরা দেখছি, যারা গণতন্ত্রের কথা বলছেন, তারা আবার নির্বাচন কমিশনে গিয়ে ধমক দিচ্ছেন, ‘এই দেশেইতো থাকবেন নির্বাচনের পরে। বাংলাদেশেইতো থাকতে হবে। আমরা দেখে নেব।

“তারা কিন্তু ৫০ শতাংশ নারীর বিষয়ে কিছু বলছেন না। নারীরা নির্বাচনে দাঁড়ালে পোশাকসহ নানা বিষয়ে কথা উঠে। অথচ নারীর সমানাধিকারের বিপক্ষে কোনো পরিবেশ এখানে থাকবে না, এমন কথাই আমাদের সংবিধানে ছিল।”

গত ১০ বছর শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার থাকার কারণে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে ‘অনেক অগ্রগতি হয়েছে’ দাবি করে আলোচনা সভার মূলপ্রবন্ধে নিরাপত্তা বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত মেজর মোহাম্মদ আলী শিকদার বলেন, “উগ্র ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর একটি বড় অংশ নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে উগ্রবাদ ত্যাগ করে চিরন্তন শান্তির পথে ফিরে আসতে শুরু করেছে।”

নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রতিজ্ঞা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “আসুন, আমরা ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির কবল থেকৈ বাংলাদেশকে স্থায়ীভাবে মুক্ত করার জন্য আমাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করি। বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিরোধী এবং সাম্প্রদায়িক পক্ষ ও ব্যক্তিকে আমরা কেউ ভোট দেব না, এই প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ হই।”

সম্প্রীতি বাংলাদেশের সদস্য সচিব ডা. মামুন আল মাহতাবের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান, পূজা উদযাপন পরিষদের নেতা চিত্তরঞ্জন দাস, খ্রিস্টান ধর্মীয় নেতা প্রলয় সমাদ্দার বক্তব্য দেন।