• শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩১

  • || ০৮ জ্বিলকদ ১৪৪৫

নামে নামে, প্রকল্প থামে

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ২ ডিসেম্বর ২০১৮  

এতদিন শুনে এসেছেন ‘নামে নামে,যমে টানার গল্প’।  আজ শুনবেন ‘নামে নামে প্রকল্প থামার গল্প।  অবশ্য গল্প নয়, এ এক সত্য ঘটনা।  পড়তে পড়তে পাঠক বিস্মিত হবেন, হতবাক হবেন।  ভাববেন, এরকম দিনগুলোও পেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশ! চলুন চমকে যাবার সেই গল্পের মতো বাস্তব ঘটনাটি জেনে নেয়া যাক।

২০০২ সালের জানুয়ারি মাস।  ক্ষমতায় বিএনপি জামায়াত সরকার। ক্ষমতায় এসেই বিরোধী দল ও মতের ওপর অত্যাচারের স্টীমরোলারটি বেশ ভালোভাবেই চালিয়েছিলো বিএনপি জামায়াত।  তাই পৈশাচিক উল্লাস ছিল খালেদাসহ বিএনপি জামায়াতের সকলের মধ্যে।

জানুয়ারির সেই অল্প রোদের দুপুরে মন্ত্রিসভার বৈঠক চলছিল যথারীতি। খালেদা জিয়া সাধারণত মন্ত্রিসভার বৈঠকে চুপচাপ বসে থাকেন। আলোচ্য বিষয়গুলো উত্থাপিত হয়, কিছু আলোচনা হয়।  তিনি শুধু শুনে যান।  তার নীরবতাই সম্মতির লক্ষণ।

ক্যাবিনেটে সেদিন এলো শিক্ষকদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণের প্রস্তাব। নেদারল্যান্ড সরকারের আর্থিক অনুদানে বাংলাদেশে সাত হাজার ৭০০ শিক্ষককে আইটি প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।  এজন্য নেদারল্যান্ডের টিউলিপ কম্পিউটার বাংলাদেশে ১১ হাজার কম্পিউটার ও প্রশিক্ষণ সহায়তা দেবে।  এই প্রকল্পের ব্যয় হিসেবে ১০ মিলিয়ন পাউন্ড দেবে ডাচ সরকার।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ-নেদারল্যান্ড সরকারের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয় ২০০০ সালে।  অর্থাৎ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে।  চুক্তি স্বাক্ষরের পর ডাচ সরকার টিউলিপ কম্পিউটারকে কম্পিউটার সরবরাহ ও প্রশিক্ষণের কাজ দেয়।  সে অনুযায়ী কাজও শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি।  সরকার পরিবর্তন হওয়ায় এটা মন্ত্রিসভায় এসেছে পুনঃঅনুমোদনের আনুষ্ঠানিকতার জন্য।

সরকার পরিবর্তন হলেও এ ধরণের কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা সাধারণত অটুট থাকে।  কিন্তু এবার ঘটে গেলো ব্যতিক্রম ঘটনা।

মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘টিউলিপ কম্পিউটার্স’ নাম শোনামাত্রই খালেদা ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলেন।  তিনি জানান, এই চুক্তি বাতিল করতে হবে।  শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষাসচিব তাকে জানান, নেদারল্যান্ড ইউরোপীয় ইউনিয়নের শক্তিশালী সদস্য।  বছরে দেশটি বাংলাদেশকে ৩০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেয়। খালেদা রেগে গিয়ে সাফ জানিয়ে দেন, এই চুক্তি বাতিল করতেই হবে। একথা বলেই তিনি ক্যাবিনেট মিটিং থেকে উঠে গেলেন।

খালেদা জিয়ার এমন আচরণ দেখে শিক্ষামন্ত্রী ও সচিব তো থ! দুজনই দ্বারস্থ হলেন মুখ্য সচিব ড. কামাল সিদ্দিকীর।  ড. কামাল সিদ্দিকী কথা বললেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে।  খালেদা ড. সিদ্দিকীকে যা বললেন তাতে তার  আক্কেলগুড়ুম।

খালেদা জিয়া জানিয়েছেন, ‘টিউলিপ’ শেখ রেহানার মেয়ের নাম।  ওই প্রতিষ্ঠান থেকে কেন কম্পিউটার কিনতে হবে?’
মুখ্য সচিব বুঝলেন এ নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই।  তাও বললেন ‘টিউলিপ নেদারল্যান্ডের একটি আইটি প্রতিষ্ঠান।  স্থাপিত হয় ১৯৭৯ সালে।  এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে শেখ রেহানা বা তাঁর পরিবারের সম্পর্ক নেই।’। কিন্তু কে শোনে কার কথা!

খালেদা জিয়া চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্তে অনড়।  ড. কামাল সিদ্দিকীও নাছোড়বান্দা, তিনি বললেন এই চুক্তি বাতিল করলে বাংলাদেশকে ৪.২ মিলিয়ন ডলার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।  কিন্তু খালেদা জিদ ধরে বললেন, ‘টিউলিপ নামে কোন কিছু বাংলাদেশে হবে না’।

মূখ্য সচিব তার ব্যর্থতার কথা শিক্ষামন্ত্রীকে জানালেন।  শিক্ষামন্ত্রী ড. ওসমান ফারুক একরাশ হতাশা নিয়ে চুক্তি বাতিলের জন্য নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূতকে ডাকলেন।  নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত বিস্ময়ে হতবাক, বাংলাদেশে ১১ হাজার কম্পিউটার আসবে, প্রায় ৮ হাজার শিক্ষক কম্পিউটার প্রশিক্ষণ পাবে, আর তারা শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার শেখাবে।  এরকম একটি  চুক্তি কেন সরকার বাতিল করবে?

যাই হোক শেষ পর্যন্ত সরকার চুক্তি বাতিল করল।  টিউলিপ লিমিটেড, বাংলাদেশ সরকারের কাছে ৪.২ মিলিয়ন পাউন্ড ক্ষতিপূরণ চাইল।  কিন্তু আবার বেঁকে বসলেন খালেদা।  তিনি বললেন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী রিয়াজ রহমান বেগম জিয়াকে নিজে বোঝালেন, সেই সাথে মন্ত্রী সভার আরও অনেকেই খালেদা জিয়াকে বোঝালেন। কিন্তু তিনি অনড়।

টিউলিপ লিমিটেড মামলা করল।  আদালত বাংলাদেশ সরকারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দিল।  কোর্টের আদেশও মানলেন না খালেদা জিয়া।  এরপর আন্তর্জাতিক আদালত নেদারল্যান্ডের সহায়তা বাংলাদেশে বন্ধের আদেশ দিল।  বন্ধ হয়ে গেলো বাংলাদেশে ডাচ অনুদান ও সহায়তা।  বাংলাদেশের শিশু ও নারীরা ৫৬৭ কোটি টাকার সাহায্য থেকে বঞ্চিত হলো।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, বেগম জিয়া শুধু চুক্তি বাতিলই করেননি, গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে খবর নিয়েছিলেন যে টিউলিপ এর মালিকানা কার। গোয়েন্দা সংস্থা যখন জানায় এই টিউলিপের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর নাতনি টিউলিপের কোনো সম্পর্ক নেই, ততক্ষণে বাংলাদেশে নেদারল্যান্ড সরকার তার সব সহায়তা বন্ধ করে দেয়।