• শনিবার ১৮ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৪ ১৪৩১

  • || ০৯ জ্বিলকদ ১৪৪৫

লাশ আসেনি এক মাসেও

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ৪ অক্টোবর ২০১৯  

সৌদি আরবে অমানুষিক নির্যাতনে নাজমা বেগম (৪০) নামে মানিকগঞ্জের এক নারী শ্রমিকের মৃত্যুর অভিযোগ উঠেছে। মৃত্যুর আগে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়ে স্বজনদের কাছে বার বার বাঁচার আকুতি জানিয়েছিলেন হতভাগ্য ওই নারী। কিন্তু দরিদ্র পরিবারটি তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। এক মাস ধরে নিহতের মরদেহ সৌদি আরবের একটি হাসপাতালের হিমঘরে পড়ে থাকলেও দেশে আনতে পারছে না পরিবারটি।

নাজমা বেগমের বাড়ি মানিকগঞ্জের সিঙ্গাইর উপজেলার তালেবপুর ইউনিয়নের ইসলামনগর গ্রামে। ১০ মাস আগে স্থানীয় এক দালালের মাধ্যমে সৌদিতে যান তিনি। হাসপাতালের ক্লিনার হিসেবে চাকরি দেয়ার কথা বলে তাকে বাসাবাড়িতে কাজ দেয়া হয়। যাওয়ার পর থেকেই পাশবিক নির্যাতনসহ নানাভাবে নির্যাতন করা হতো তাকে। মৃত্যুর দুদিন আগেও দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য স্বজনদের কাছে আকুতি জানান নাজমা।

সরেজমিনে নাজমার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মায়ের ছবি হাতে নিয়ে দুই ছেলে-মেয়ে কান্না করছে। পাশে বসে ভাবির স্মৃতি তুলে ধরে বিলাপ করছেন ননদ রাশেদা বেগম। তাদের কান্না দেখে চোখের পানি ঝরছে উপস্থিত কয়েকজন প্রতিবেশীরও।

নাজমার বোন মাখসুদা বেগম জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে অভাবের সংসার ছিল নাজমার। তাই সংসারে স্বচ্ছলতা ফেরাতে পার্শ্ববর্তী রাজেন্দ্রপুর গ্রামের আয়নাল হকের ছেলে মো. সিদ্দিকের মাধ্যমে সৌদিতে যান তিনি। হাসপাতালের ক্লিনার হিসেবে চাকরির কথা বলে সিদ্দিক তাকে নানাভাবে প্রলোভিত করে। কিন্তু সৌদিতে তাকে গৃহকর্মী হিসেবে বিক্রি করা হয়। সেখানে যাওয়ার পর থেকেই মালিকের ছেলে তাকে যৌন নির্যাতন করতো। কথা না শুনলে বেধরক মারপিট করা হতো। এছাড়া পরিবারের অন্য সদস্যরা তাকে নানা অজুহাতে মারপিট করাসহ ঠিকমতো খেতেও দিতো না। এসব কারণে নাজমা প্রায়ই তার বোন ও ছেলে মেয়েদের ফোন করে কান্নাকাটি করতেন। যে কোনো মূল্যে তাকে দেশে ফিরিয়ে নিতে বলতেন। অমানুষিক নির্যাতনের কারণেই নাজমার মৃত্যু হয়েছে বলে জানান তিনি।

নাজমার ছেলে রাজিব মিয়া জানান, মায়ের নির্যাতনের খবর শুনে তারা বহুবার সিদ্দিকের কাছে গেছেন। মাকে ফিরিয়ে আনতে তার হাত-পা পর্যন্ত ধরা হয়েছে। কিন্তু তিনি বিষয়টি গুরুত্ব দেয়নি। উল্টো তাদের ধমক দিয়ে সরিয়ে দিয়েছেন।

তিনি আরও জানান, গত ২ সেপ্টেম্বর ভোরে এক সৌদি প্রবাসী তাদের ফোন করে মায়ের মৃত্যুর খবর দেন। সৌদি আরবের আরা শহরের একটি সরকারি হাসপাতালের হিমঘরে তার মায়ের মরদেহ রাখা হয়েছে বলে তাদের খবর দেয়া হয়। এরপর তারা আবারও সিদ্দিকের কাছে গিয়ে মরদেহ দেশে আনতে অনুরোধ জানান। কিন্তু মরদেহ আনতেও নানা গরিমসি করছে সিদ্দিক। এ কারণে একমাস পেরিয়ে গেলেও নাজমার মরদেহ দেশে আনা যায়নি। কীভাবে মায়ের মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা যায় তাও তাদের জানা নেই।

মৃত্যুর কয়েক দিন আগে স্বজনদের সঙ্গে কথা বলার কয়েকটি অডিওতে শুনা যায়, নাজমা তার ওপর নির্যাতনের বর্ণনা দিচ্ছেন আর কান্নাকাটি করছেন। তিনি প্রচণ্ড অসুস্থ। ব্যাথায় উঠতে পারছেন না। কিন্তু তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে না। একটি অডিওতে শুনা যায়, তাকে বাসা থেকে কোথায় যেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তিনি বলছেন, আমাকে আর বাঁচাতে পারলি না তোরা। আমাকে আর জীবিত পাইলি না। বাড়ি বিক্রি করে হলেও তাকে বাঁচাতে বলেন স্বজনদের।

স্থানীয় ইউপি সদস্যসহ কয়েকজন গ্রামবাসী জানান, ভালো চাকরির লোভ দেখিয়ে নাজমাকে বিদেশে পাচার এবং সেখানে নির্যাতনের শিকার হয়ে নির্মম মৃত্যুর ঘটনা খুবই দুঃখজনক। পুরো ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের শাস্তির দাবি জানান তারা।

এদিকে অভিযুক্ত আদম ব্যবসায়ী সিদ্দিককে তার বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায়নি। তবে তার স্ত্রী হালিমা বেগম জানান, তার স্বামী এলাকার অন্তত ৫০/৬০ জন নারীকে বিদেশে পাঠিয়েছেন। কিন্তু কারও বেলায় সমস্যা হয়নি। নাজমা নির্যাতিত হচ্ছে এ বিষয়টি তাদের আগে জানানো হয়নি। মারা যাওয়ার কয়েকদিন আগে জানতে পেরেছেন তারা। মরদেহ বিদেশ থেকে আনতে তার স্বামী চেষ্টা চালাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।

সিঙ্গাইর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রাহেলা রহমত উল্লাহ জাগো নিউজকে জানান, বিষয়টি তার জানা ছিলো না। নিহতের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত যাতে মরদেহ দেশে ফিরিয়ে আনা যায় সে বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে।