• সোমবার ২০ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৬ ১৪৩১

  • || ১১ জ্বিলকদ ১৪৪৫

অধ্যক্ষের পরিকল্পনায় নুসরাত হত্যা

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১৪ এপ্রিল ২০১৯  

যৌন নিপীড়নের বিচার চাওয়ায় ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে নৃশংশ হত্যার চাঞ্চল্যকর তথ্য বেড়িয়ে আসছে। হত্যাকারীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেই নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করেছিল। নুসরাতকে আগুন দেয়ার ঘটনায় সরাসরি যুক্ত ছিল ৬ জন। আর পুরো ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিল ১৩ জন। সরাসরি যুক্ত ৬ জনের মধ্যে ৩ জন ছাত্র এবং ৩ জন ছাত্রী। এরা ৬ জনই একই মাদরাসার শিক্ষার্থী। 

নুসরাত জাহান রাফি হত্যার তদন্তে উঠে এসেছে এসব তথ্য। শনিবার প্রেস ব্রিফিংয়ে মামলা তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে  জানায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। রাজধানীর ধানমন্ডিতে পিবিআই হেড কোয়ার্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরেন পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার।

আটজনের নাম উল্লেখ করে এই মামলায় অজ্ঞাত ৪-৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ওই ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত অন্যরা হলেন- পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলম (৪৫), মাদরাসার ইংরেজি অধ্যাপক আফচার উদ্দিন (৩৫), আলাউদ্দিন (৩০), কেফায়েত উল্লাহ (৩২) নুসরাতের সহপাঠী ও অভিযুক্ত অধ্যক্ষের ভাগনী উম্মে সুলতানা পপি (১৮), শাহাদাত হোসেন শামীম, মাদরাসা ছাত্র নূরউদ্দিন (১৯), নূর হোসেন (২১) ও শহীদুল ইসলাম (১৯), জোবায়ের আহমেদ (২১), জাবেদ হোসেন (১৯), আরিফুর ইসলাম (১৯) ও আলাউদ্দিন (২০)। সন্দেহভাজন আরেক হাফেজ আবদুল কাদের এখনো পলাতক। 

এরই মধ্যে নুসরাতকে যৌন নিপীড়ন ও পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ এ এস এম সিরাজ উদ দৌলা এবং ইংরেজির প্রভাষক আফসার উদ্দিনের এমপিও স্থগিত করা হয়েছে। এর ফলে তারা বেতন-ভাতার সরকারি অংশ পাবেন না।

নুসরাত জাহান রাফিকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিল ওই মাদরাসার শিক্ষক সিরাজ উদ দৌলা। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে ১৩ জনের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পেয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। আর নুসরাতের গায়ে সরাসরি আগুন দেয় চার জন। তাদের একজন শাহাদাত হোসেন শামীম। আরেকটি মেয়ে ছিল (যার পরিচয় গোপন রাখা হয়েছে)। নুসরাতের গায়ে আগুন দিয়ে মাদরাসার মূল গেট দিয়েই পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। 

তিনি বলেন, অধ্যক্ষ সিরাজের কু-কৃর্তির প্রতিবাদ ও শাহাদাতের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় নুসরাতকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ কাজ করতে জেলখানা থেকে নির্দেশ দেন অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ উদ-দৌলা। আর নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার পরিকল্পনা করেন শাহাদাত হোসেন শামীম।

তিনি বলেন, ওই পরিকল্পনা অনুযায়ী বোরখা পরিহিত চারজন ভবনের ছাদে নুসরাত হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেয়। এর মধ্যে কমপক্ষে একজন মেয়েও ছিল বলে ধারণা করছে বিপিআই। হত্যাকাণ্ড পরিচালনায় এখন পর্যন্ত দুজন মেয়েসহ ১৩ জনের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে তদন্তকারী সংস্থা।

নুসরাতকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনার সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উন্নত চিকিৎসার জন্য নুসরাত রাফিকে সিঙ্গাপুরে পাঠানোরও পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সবার প্রার্থনা-চেষ্টাকে বিফল করে ১০ এপ্রিল রাতে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান ‘প্রতিবাদী’ নুসরাত।

এরআগে শুক্রবার গ্রেফতার মকসুদকে জিজ্ঞাসাবাদে নুসরাত হত্যাকাণ্ডে ওই মাদরাসার ছাত্র শাহাদাত হোসেন শামীম, হাফেজ আবদুল কাদেরের নামসহ পরিকল্পিত আগুনের ঘটনার চাঞ্চল্যকর তথ্য পায় পিবিআইয়ের  গোয়েন্দারা। তবে পিবিআইয়ের কর্মকর্তা ফেনীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এএসপি) মো. মনিরুজ্জামান মামলার তদন্তের স্বার্থে বিষয়গুলো প্রকাশে রাজি হননি। 

তিনি বলেন, ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত হত্যা মামলার অন্যতম আসামি সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলম ঘটনার পর থেকেই পলাতক ছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করা হলেও তিনি ছিলেন ঢাকায়।
 
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর ফকিরের পুলের একটি আবাসিক হোটেল থেকে কাউন্সিলর মকসুদ আলমকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পরই তাকে সরাসরি ফেনী নিয়ে আসা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের পর চট্টগ্রাম থেকে গ্রেফতার করা হয় মকসুদের সহযোগী ও নুসরাত হত্যায় জড়িত সন্দেহভাজন জাবেদকে। তাকেও চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি ফেনী আনা হয়। দুজনকে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদের পর, তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী শুক্রবার সকালে ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে গ্রেফতার করা হয় আরেক সহযোগী নুরউদ্দিনকে। তাকে নিয়ে পিবিআইয়ের অপর একটি টীম শুক্রবার রাতেই ফেনী যায়।

নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার অন্যতম আসামি ও অভিযুক্ত অধ্যক্ষ এস এম সিরাজ-উদ-দৌলার মুক্তির দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন নুরউদ্দিন। 

নুরউদ্দিনকে গ্রেফতার প্রসঙ্গে ময়মনসিংহের পুলিশ সুপার শাহ আবিদ হোসেন জানান, বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভালুকার সিডস্টোর থেকে নুর উদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ বুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) বিশেষ টিম। তাদের সহায়তা করে ভালুকা মডেল থানা পুলিশ। তিনি আরো বলেন, নূরউদ্দিনকে গ্রেফতার করে পিবিআইয়ের ঢাকা কার্যালয়ে নেয়া হয়। পরে তাকে নেয়া হয় ঘটনাস্থল ফেনীর সোনাগাজীতে। 

গত ৬ এপ্রিল সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসায় আলিম পরীক্ষা দিতে গেলে ছাদে ডেকে নিয়ে নুসরাতের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে হত্যার চেষ্টা চালায় মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা। আগুনে ঝলসে যাওয়া নুসরাত চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৫ দিন পর গত বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান। 

এর আগে ২৭ মার্চ মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা প্রত্যাহারের জন্য নুসরাতকে চাপ দেয় তারা।