• বৃহস্পতিবার ১৬ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ২ ১৪৩১

  • || ০৭ জ্বিলকদ ১৪৪৫

নিজের রিকশা চালককে সংসদে ঢুকতে না দেওয়ায় অধিকার ক্ষুণ্নের নোটিশ

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ৭ নভেম্বর ২০১৮  

সাংবাদিকদের সব সময়ই সুসম্পর্ক ‘ভাটির শার্দুল’ খ্যাত রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ-এর। আর ঘনিষ্টতা বেড়েছে স্পিকারের দায়িত্বে থাকাকালে। রাষ্ট্রপতির নির্বাচিত হওয়ার চার দেয়ালে বন্দী (রাষ্ট্রপতির ভাষায়) হলেও সাংবাদিকদের সঙ্গে নিয়মিত সম্পর্ক রক্ষা করেন। কারণে-অকারণে ছুটে যান সংসদ ভবনে। সেখানে রাষ্ট্রপতির দপ্তরে বসার পাশাপাশি প্রটোকল ভেঙ্গে সাংবাদিক লাউঞ্জে যেতে ভুল করেন না। সেই সাংবাদিকদের নিয়ে তিনি সোমবার রাতে বঙ্গভবনে আড্ডায় বসেছিলেন। আপ্যায়ন করেছেন নিজের ইচ্ছামতো। সেখানে তিনি ব্যক্ত করেছেন নিজের পুরো দিনের কথা।

সংসদ সদস্য নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য বয়স ২৫ বছর হওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু সেই সময়ের ছাত্রলীগ নেতা মো. আবদুল হামিদ এক মাস ১৯ দিন বাকী থাকতেই পাকিস্তান গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সারা পাকিস্তানে সর্বকনিষ্ট সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলাম। তখন আমার বয়স ছিল ২৫ বছরের চেয়ে একমাস ১৯ দিন কম। নির্বাচনের পর এনিয়ে মামলাও হয়েছিলো। কিন্তু পরে তো যুদ্ধ শুরু হলো। তিনি আরো বলেন, পাকিস্তান আমলে এমএলএ ছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এমপি হয়েছি। কিশোরগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির ৫ বার সভাপতি নির্বাচিত হয়েছি। জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলাম ৩৮ বছর। আমার জীবনে কোন হার নাই।’

জনগণের পাশাপাশি নিজের অধিকার আদায়ে আবদুল হামিদ সব সময়ই স্বোচ্ছার ছিলেন। কনিষ্ট সংসদ সদস্য হলেও সাহস দেখিয়েছেন অনেক। প্রথম সংসদের বর্ণাঢ্য দিনগুলোর কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এমপিরা গাড়ি নিয়ে সংসদে যায়। আমি প্রথমবার গেছিলাম রিকশা নিয়ে। গেটে আটকাইয়া দিছিলো। আমি বলেছিলাম, এমপি সাহেব যদি গাড়ির ড্রাইভার নিয়ে যেতে পারে, তবে আমার রিকশার ড্রাইভার নিয়ে কেন যেতে পারবো না?’ রিকশা নিয়ে যেতে না দেওয়ায় সংসদে গিয়ে বিশেষ অধিকার কমিটিতে অধিকার ক্ষুণ্ণের নোটিশ দিলাম।’

রাষ্ট্রপতি জানান, সেই নোটিশ তুলে নিতে তৎকালীণ প্রধান হুইপ শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন (বর্তমানে বিএনপি নেতা) অনুরোধ করলেও তা প্রত্যাহার করেননি। পরে হুইপ রাফিয়া আক্তারের মাধ্যমে জানতে পারেন বঙ্গবন্ধু তাকে ডেকেছেন। আবদুল হামিদের ভাষ্যে, ‘বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, নোটিশ দিছি কি-না? কইলাম দিছি। উডাইতে (প্রত্যাহার) বললেও কইছি তুলুম না। পরে পিডের মধ্যে দিছে একটা কিল। দিয়া কইছে, তুই তোল, আমি দেখতাছি।’ পরে বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ মতো ৫ হাজার টাকা নিলামে সেনাবাহিনীর পরিত্যক্ত একটি গাড়ি কিনেছিলেন বলে জানান আবদুল হামিদ।

বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী রাষ্ট্রপতি নিজের জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো বই আকারে প্রকাশের উদ্যোগ নিয়েছেন বলেও সাংবাদিকদের জানান। আড্ডাস্থলে তার সামনে বসা দৈনিক কালের কণ্ঠ-এর সম্পাদক কথা সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনসহ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, জীবনী লেখার ইচ্ছা আছে..কিন্তু লেখার অভ্যাস তো নাই। তবুও একটা দাঁড় করানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু সুবিধা করতে পারছি না। তবে ইচ্ছা আছে ওভাবে সুন্দর না হলেও কথাগুলো তো থাকবে।’ তিনি আরো বলেন, ইমদাদুল হক মিলন সাহেবরা ভালো লেখেন। আমরা ভালো জানি। দু’পক্ষের সমন্বয় করে লেখা হলে ভালো হয়।

মূলতঃ সংসদ বিটের রিপোর্টারদের সৌজনে রাষ্ট্রপতির এই অনুষ্ঠানের আয়োজন হলেও সেখানে আমন্ত্রিত ছিলেন বিভিন্ন গণমাধ্যমের সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ। সন্ধ্যা ৭ টা থেকে গণমাধ্যম কর্মীরা বঙ্গভবনে আসতে থাকেন। মুহুর্তে বঙ্গভবনের দরবার হলে ওঠে সাংবাদিকদের আড্ডাখানা। সকলেই মোবাইলে দরবার হলের স্মৃতি ধরে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পাড়েন। রাত ৮টার দিনে সেখানে উপস্থিত হন রাষ্ট্রপতি। তিনি আসার পর পুরো দরবার হল হয়ে ওঠে প্রাণোচ্ছল। আগেই আসেন তথ্য মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ও তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। তাদের সঙ্গে কথা বলার পর সকলের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন রাষ্ট্রপতি। এসময় তিনি তার সেই চিরায়ত স্বভাব কথার হাস্যরসে দরবার হলকে প্রাণবন্ত করে তোলেন। প্রোটকলের ঘেরটেপ পেরিয়ে জুনিয়র, সিনিয়র সকল সাংবাদিকের কাছে গিয়ে হাত মেলান। এসময় যে বলেছেন, স্যার আপনার সাথে ছবি তুলব, কাউকে মানা করেননি। এমনকি তিনি নিজেই ডেকে নিয়ে বলছেন, এই ছবি তোলো। শুধু তাই না, নৈশ্যভোজ শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় রাষ্ট্রপতি নিজে এসে একজন একজন করে ডেকে নিয়ে ছবি তুলেছেন। বিদায় জানিয়েছেন।

এর আগে হাওড়ের সন্তান আবদুল হামিদ নৈশভোজে অতিথিদের আপ্যায়ন করেন তার এলাকার হাওরের মাছ দিয়ে। রাষ্ট্রপতির তৈরি করা তালিকায় ছিলো সাদা ভাত, আইড় মাছ, গুলশা টেংরা ও রূপচাঁদা মাছ। পাশাপাশি ছিলো খাসির মাংস, সবজি ও মুগ ডাল। শেষে ছিল মিষ্টি দধি ও রাজভোগ।

এসময় আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতি বলেন, সাংবাদিকদের পেয়ে আমি মহাখুশি। এটা শুধু কথার কথা না ‘আপনারা আসছেন, আপনাদের যে আনতে পেরেছি, এটা শুধু বলার জন্য বলা না, আমি অত্যেন্ত আনন্দিত।’ তিনি বলেন, যে যার অবস্থান থেকে এই দেশটাকে এগিয়ে নিতে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। সঠিক তথ্য তুলে ধরতে হবে। অনেক সময় সাংবাদিকদের ভাষায় বলা হয়, এটা দিলে বেশি খাবে না, কিন্তু যদি একটু কমও খায়, তবে তথ্য ভিত্তিক সংবাদ দিলে তার একটা আলাদা মূল্যায়ন আছে। এর একটা বিশ্বাসযোগ্যতা আছে। তিনি আরো বলেন, অনেক সময় এমনও হতে পারে,  আচ্ছা ও আমাদের সাথে একটু ঝামেলা করছে, তাই একটু টুইস্ট করে দেই, এটা করা ঠিক না। এতে যার বিরুদ্ধে করলেন, তার যতটানা ক্ষতি হবে, তার চেয়ে আপনারই বেশি ক্ষতি হবে। আপনার মনের মধ্যে একটা অপরাধ বোধ কাজ করবে।

রাষ্ট্রপতি বলেন, সাংবাদিকরা পার্লামেন্টের বিরাট একটা পার্ট। এখন তো অনেক টিভি হয়েছে, যখন শুধু পত্রিকা ছিল, তখন পার্লামেন্টে কি হচ্ছে, তা দেশের মানুষ জানতো না, যদি সাংবাদিকরা পার্লামেন্টে না যেতেন। সংসদের ভেতরে কি হচ্ছে, সে সম্পর্কে জানার জন্য সাংবাদিকরা হচ্ছেন বড় হাতিয়ার। এই হাতিয়ার ছাড়া পার্লামেন্ট সম্পর্কে মানুষ কিছুই জানতো না। সুতরাং আপনাদেরকেও মনে রাখতে হবে ‘আমরা সংসদের অংশ’।

সাংবাদিকদের সঙ্গে নিজের ঘনিষ্ট সম্পর্কের কথা তুলে ধরে রাষ্ট্রপতি বলেন, বরাবরই সাংবাদিকদের সাথে আমার একটা সুসম্পর্ক ছিল। বিশেষ করে আমি যখন ডেপুটি স্পিকার ও পরে স্পিকার ছিলাম। এখন রাষ্ট্রপতি হয়েছি, এখন প্রোটকলের কারণে খুব কষ্টে আছি, প্যারায় আছি। তবে রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরেও পার্লামেন্টে গেছি, কিন্তু সাংবাদিক লাউঞ্জে যাইনি, এমন কোনো নজির নেই। তিনি বলেন, সব রিপোর্টারদের সাথেই আমার সুসম্পর্ক ছিল। তবে আমি কোনদিন কাউকে বলিনি, আমার পক্ষে লেখেন। আপনাদের যার যেটা ভাল মনে হয় লিখবেন। সমালোচনা পর্যালোচনা করবেন, এটাই আপনাদের কাজ। নেতিবাচক খবর পাঠক খায়। তথ্য সত্য হলে বস্তুনিষ্ঠ হলে সেটা হতেই পারে। তথ্য পুরো সত্য না হলে, সেটা না হওয়াই উচিত।

অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বাসস-এর প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, কালের কণ্ঠের সম্পাদক ইমদাদুল হক মিলন, বাংলাদেশ প্রতিদিনের সম্পাদক নঈম নিজাম, জাতীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, একুশে টিভির সিইও মনজুরুল আহসান বুলবুল, যুগান্তরের সম্পাদক সাইফুল আলম, ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত, একাত্তর টিভির সিইও মোজাম্মেল হক বাবু, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোল্লা জালাল, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি আবু জাফর সূর্ষ, বাংলাদেশ প্রতিদিনের নির্বাহী সম্পাদক পীর হাবিবুর রহমান, ইউএনবি’র সিইও মাহফুজ আহমেদ, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাইফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক শুকুর আলী শুভ, বাংলাদেশ পার্লামেন্ট জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি আশিষ সৈকত ও বর্তমান সভাপতি উত্তর চক্রবর্তী প্রমূখ।