• শুক্রবার ১৭ মে ২০২৪ ||

  • জ্যৈষ্ঠ ৩ ১৪৩১

  • || ০৮ জ্বিলকদ ১৪৪৫

বেতন চাইলেই বেড়ে যেত নির্যাতন: সৌদি ফেরত নারী

মানিকগঞ্জ বার্তা

প্রকাশিত: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৯  

রাজিয়া বেগমের (ছদ্মনাম) বয়স ৩৫ বছর হলেও দেখে মনে হবে পঞ্চাশ ছাড়িয়ে গেছে। পায়ে ব্যান্ডেজ। সারা শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন। ৭ মাস ১৩ দিন আগে তিনি সৌদি আরব গিয়েছিলেন গৃহকর্মীর কাজ করতে।

পুরোপুরি সুস্থ অবস্থায় গেলেও দেশে ফিরেছেন কঙ্কালসার দেহ নিয়ে। গৃহকর্তা এবং গৃহকর্ত্রী শুধু নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয়নি, রাজিয়াকে ঠিকমতো খেতেও দেয়নি। মাস শেষে বেতন চাইলেই বেড়ে যেত নির্যাতনের মাত্রা। ৪ মাস আগে একবার বেতন চাওয়ায় তাকে তিন তলা থেকে বাইরে ছুড়ে ফেলে দেয় গৃহকর্তা। পরে পুলিশ রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে রাজিয়াকে হাসপাতালে ভর্তি করে।

২ মাস চিকিৎসা নেয়ার পর তার স্থান হয় বাংলাদেশ দূতাবাসের ‘সেফ হোমে’। সেখানে ২ মাস থাকার পর বৃহস্পতিবার সকালে আরও ১৭ নির্যাতিত নারীর সঙ্গে তিনি দেশে ফেরেন। তাদের দেশে ফিরতে সহযোগিতা করেছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক।

রাজিয়ার সঙ্গে ফিরে আসা নারীরাও ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় সৌদি আরবে গিয়েছিলেন। তারাও নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরেছেন শূন্য হাতে। এমিরেটস এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে দেশে ফেরার পর হযরত শাহজাহাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাজিয়াসহ কয়েকজন নারী এ প্রতিবেদককে নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছেন। তারা গণমাধ্যমে তাদের নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়েছেন।

ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান বলেন, ‘শুধু সৌদি আরব নয়, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে গৃহকর্মীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। গত ৯ মাসে আট শতাধিক নির্যাতিত নারী শ্রমিক শুধু সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন। আর ৪ বছরে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে নির্যাতিত হয়ে ১০ হাজার গৃহকর্মী দেশে ফিরেছেন। এ বিষয়ে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।’

ফেরত আসা নারীদের ভাষ্য, গৃহকর্মীর কাজ করতে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে যাওয়া অনেক নারীকে ‘যৌনদাসী’ মনে করে গৃহকর্তা। এ বিষয়ে মুখ খুললেই মানসিক এবং শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয়।

রাজিয়া বেগম (ছদ্মনাম) জানান, তার গ্রামের বাড়ি বৃহত্তর সিলেটে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তার স্বামী কোনো কাজ করতে পারেন না। এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে তাদের সংসারে। দরিদ্র পরিবারের অভাব ঘোচাতে এক দালালের মাধ্যমে সৌদি আরব যান তিনি। সেখানে যেতে তার কোনো অর্থ খরচ করতে হয়নি। কারণ দালাল তাকে সৌদি নাগরিকের কাছে বেচে দিয়েছিল।

ওই বাসায় নানা অজুহাতে তার ওপর চালানো হতো অমানসিক নির্যাতন। নির্যাতন সহ্য করে ৩ মাস পর বেতন চান তিনি। বেতন চাওয়াতে তিন তলা থেকে তাকে রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দেয়া হয়। এখন তিনি পঙ্গু হওয়ার পথে। অন্যের সাহায্য ছাড়া চলতে পারেন না। সামনের দিনগুলো কিভাবে যাবে তা তিনি জানেন না।

সিলেটের আরেক নারী ৩ বছরের শিশু সন্তানকে স্বামীর কাছে রেখে ৪ মাস আগে সৌদি আরবে যান। তার স্বামী একজন ভূমিহীন কৃষক। পরিবারের অভাব ঘোচাতে তিনি এক দালালের মাধ্যমে সৌদি আরবে পাড়ি জমান।

সেখানে তিনি একটি বাড়িতে গৃহকর্মী হিসেবে কাজে যোগ দেন। গৃহকর্তাসহ ওই বাড়ির লোকজন তার ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালায়। তাকে প্রতি মাসে ৯০০ সৌদি রিয়াল দেয়ার কথা থাকলেও তিনি কোনো অর্থই পাননি। নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তিনি ১ মাস আগে ওই বাসা থেকে পালিয়ে যান। পরে তিনি বাংলাদেশ দূতাবাসের সেফ হোমে আশ্রয় নেন।

ফেরত আসা অন্যরা জানান, দালালদের মাধ্যমে তারা বিভিন্ন বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ পান। চুক্তি অনুযায়ী মাস শেষে বেতন পাওয়ার কথা থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা কোনো বেতন পেতেন না।

কারণে-অকারণে গৃহকর্তা, গৃহকর্ত্রী ও তাদের সন্তানরা মারধর করত। কোনো কোনো গৃহকর্তা যৌন নিপীড়নও চালাত। ঠিকমতো খেতে দেয়া হতো না। অসুস্থ হলে চিকিৎসা করানো হতো না। ভাগ্য ফেরাতে সৌদি আরব গেলেও তারা ফিরেছেন নিঃস্ব হয়ে।